পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৫২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চন্দ্রাবতীর রামায়ণ
৫২৩

 যখন জাল ইতিহাস সৃষ্টি করার চেষ্টা অসাধ্য হইল, তখন নানা প্রকার অলৌকিক কিংবদন্তী দ্বারা রামায়ণের এই ঘটনাটিকে পুরণ করিবার আবশ্যক হইয়াছিল। সীতার উদ্ভব সম্বন্ধে কত কথাই যে কত পুরাণে রহিয়াছে, তাহার অবধি নাই।

 জাভা দেশের রামায়ণে লিখিত আছে যে সীতা রাবণ এবং মন্দোদরীর কন্যা। গণকেরা ভবিষ্যদবাণী করিয়াছিল, সীতা অতি দুর্ভাগিণী হইবেন। সুতরাং রাবণ জন্মমাত্র একটি কৌটায় শিশুটিকে আবদ্ধ করিয়া তাহা সমুদ্রে ভাসাইয়া দেন। জনক ঐ কৌটাটি উদ্ধার করেন। মালয় দেশের রামায়াণে আছে সীতা মন্দোদরীর কন্যা এবং তিব্বতী রামায়ণে সীতাকে রাবণের কন্যা বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। কাশ্মীরী রামায়ণেও সীতাকে রাবণের কন্যা বলিয়াই উল্লেখ করা হইয়াছে (দিবাকর প্রকাশ-প্রণীত কাশ্মীরী রামায়ণ—গ্রীয়ারসনের অনুবাদ)। শ্রীযুত ডব্লিউ স্‌টটার হ্যাম, (হল্যান্দ ইণ্ডিয়া সোসাইটির সম্পাদক) এই প্রসঙ্গ লইয়া বহু গবেষণা করিয়াছেন এবং তিনি আমাকে যে পত্র লিখিয়াছেন তাহাতে রামায়ণ সম্বন্ধে নানা দেশে প্রচলিত নানা উপাখ্যান ও গুজবের একটা তালিকা দিয়াছেন। আমাদের বাঙ্গালা রামায়ণেও সীতার জন্ম সম্বন্ধে নানারূপ আজগুবি গল্প লিপিবদ্ধ হইয়াছে। সীতা পৃথিবীর কন্যা, একটা ডিম্বরূপে জনকের হলাগ্র-ভাগে তিনি উত্থিত হন, ইত্যাদি কথা এদেশে সর্ব্বজনবিদিত।

 আশ্চর্য্যের বিষয় চন্দ্রাবতীর রামায়ণে বাল্মীকি বা কৃত্তিবাসের বৃত্তান্তের অনুরূপ কাহিনী আমরা পাই না। তির্ব্বত, মালয়, কাশ্মীর, জাভা প্রভৃতি স্থানে সীতার জন্ম সম্বন্ধে যে সব প্রবাদ প্রচলিত আছে, চন্দ্রাবতী সেই সকল কথাই আমাদিগকে শুনাইয়াছেন। আমরা যখন প্রথম চন্দ্রাবতীর রামায়ণ পাঠ করি তখন তদ্‌বর্ণিত কুকুয়ার চিত্রটি তাঁহারই মৌলিক কল্পনা বলিয়া মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু এখন দেখিতেছি। এই কুকুয়া চন্দ্রাবতীর সৃষ্টি নহে। এই চরিত্রটি কাশ্মীরী, মালয়, জাভা, কম্বোজ এবং তিব্বতী রামায়ণেও পরিদৃষ্ট হয়। মোট কথা। চন্দ্রাবতী মূল রামায়ণ পাঠ করিলেও তাঁহার জন্মভূমির নিকটবর্ত্তী প্রদেশে রামসীতা সম্বন্ধে যে সমস্ত কাহিনী প্রচলিত ছিল, তাহা হইতেই অধিকতর উপাদান সংগ্রহ করিয়াছেন।