পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৫২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫২৪
পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা

 অনেকেই জানেন জৈনদিগের রচিত কতকগুলি রামায়ণ আছে। তন্মধ্যে খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে প্রাকৃত ভাষায় লিখিত “পউম চরিয়ম” (পদ্ম চরিত) নামক গ্রন্থই প্রসিদ্ধ। একাদশ শতাব্দীতে জৈন কবি হেমচন্দ্র আর একখানি রামায়ণ প্রণয়ন করেন। বাল্মীকির রামায়ণের সঙ্গে এই সকল রামায়ণের অনেক স্থলে অনৈক্য দৃষ্ট হয়। সকলেই জানেন বৌদ্ধ এবং জৈনেরা রাবণের পক্ষপাতী ছিলেন। মহাযান সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, রাবণ বুদ্ধের অন্যতম প্রধান শিষ্য ছিলেন। লঙ্কাবতার-সূত্র নামক সংস্কৃত গ্রন্থে বুদ্ধের সঙ্গে রাবণের অনেক তর্ক-বিতর্ক বর্ণিত হইয়াছে। এই পুস্তকের কতকাংশ কলিকাতা সংস্কৃত কলেজ হইতে প্রকাশিত হইয়াছে। জৈন কবি হেমচন্দ্র রাবণের যে চিত্র আঁকিয়াছেন তাহা সিদ্ধপুরুষের। মৎকৃত Bengali Ramayanas গ্রন্থে এ সম্বন্ধে আমি বিশেষভাবে আলোচনা করিয়াছি। জৈন কবির গ্রন্থে রাবণের কথা লইয়াই রামায়ণের মুখবন্ধ করা হইয়াছে এবং সেই অধ্যায়ই অতিদীর্ঘ, রামের চিত্র পরবর্ত্তী এবং রাবণের ন্যায় উজ্জ্বল নহে। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে আমাদের চন্দ্রাবতীও রাবণের কথা লইয়াই তাঁহার রামায়ণের প্রারম্ভ করিয়াছেন এবং রাবণ সম্বন্ধে যে সকল উপাখ্যান লিখিয়াছেন তাহার মূল বাল্মীকি রামায়ণে নাই। উত্তরাকাণ্ডের সঙ্গে সেই সকল গল্পের কতক কতক ঐক্য আছে।

 রাবণ যে অতি প্রসিদ্ধ নৃপতি ছিলেন তৎসম্বন্ধে কোন সংশয় নাই। তিনি দাক্ষিণাত্যে বহু মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন (বম্বে গেজেটিয়ার ১, ৭, ১৯০, ৪৫৪ নং, ১৭, ৭৬, ২৯০,৩৪১ পৃঃ)। তিনি কেনারা প্রদেশে গোকর্ণ নামক স্থানে তপস্যা করিয়া সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন। উক্ত অঞ্চলে তাঁহার সম্বন্ধে বহু প্রবাদ আছে। ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৌদ্ধ পণ্ডিত ধর্ম্মকীর্ত্তি হিন্দুরা রাবণের চরিত্র কলঙ্কিত করিয়াছেন বলিয়া অনেক ক্ষোভ প্রকাশ করিয়াছেন।

 মৈমনসিংহের ব্রাহ্মণ্য-প্রভাব কতকটা আধুনিক। তৎপূর্ব্বে এই দেশে বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি নানা সম্প্রদায়ের নানারূপ কাহিনী ও প্রবাদ দেশময় প্রচলিত ছিল। জনসাধারণ এই সকল উপাখ্যান জানিত এবং চন্দ্রাবতী সংস্কৃত কাব্যের অনুরোধে জনসাধারণকে উপেক্ষা করিতে পারেন নাই।