পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৫২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চন্দ্রাবতীর রামায়ণ
৫২৫

এই জন্যই তিনি তাহাদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনীগুলির স্থান দিয়াছেন এবং এই জন্যই আর্য্য সমাজের বহির্ভূত প্রদেশসমূহে রামায়ণের যে বিচিত্র উপাখ্যানমালা প্রচলিত ছিল তাহদের সহিত চন্দ্রাবতীর বিবরণের এইরূপ আশ্চর্য্য সাদৃশ্য। চন্দ্রাবতীর রামায়ণে আমরা বাল্মীকিপূর্ব্ব যে সকল উপাখ্যান দেশময় প্রচলিত ছিল এবং যেগুলি হইতে নির্ব্বাচন করিয়া কতক গ্রহণ এবং কতক পরিহার করার রীতি অনুসারে বাল্মীকি তাঁহার অপূর্ব্ব মহাকাব্য রচনা করিয়াছিলেন, সেই পুরাকালীন উপাখ্যানসম্পদের কতক আভাস পাইতেছি। এই হিসাবে কবিত্বের কথা না তুলিলেও রামায়ণের এই গানের অন্যবিধ মূল্য আমরা স্বীকার করিতে বাধ্য।

 চন্দ্রাবতীর রামায়ণের ইংরাজী ভূমিকায় আমরা এতৎসম্বন্ধে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করিয়াছি। এখানে সংক্ষেপে তাহার উল্লেখ করিলাম।

 চন্দ্রাবতীর রামায়ণে সংস্কৃতের প্রভাব যে একেবারে কিছু নাই তাহাও নয়। তিনি মাঝে মাঝে দু’এক পঙ্‌ক্তি সংস্কৃত কাব্যাদি হইতে গ্রহণ করিয়াছেন, যথা—সূর্য্য হ’তে কাড়ি নিল সহস্র কিরণ। (ষষ্ঠ অধ্যায়, চতুর্থ খণ্ড, প্রথম সংখ্যা, অষ্টম ছত্র) ছত্রটি অবিকল মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর “সমস্তরোমকূপেষু স্বীয়রাশ্মীন্ দিবাকরঃ” ছত্রের ঠিক অনুরূপ। স্থানে স্থানে বৈষ্ণব পদের অনুরূপ কবিতাও দৃষ্ট হয় যথা—“কৌশল্যা রাখিল নাম কাঙালের ধন”—ইত্যাদি (সপ্তম অধ্যায় ২৬ পৃঃ) ইহা কৃষ্ণের শতনামের একটি পরিচিত গাথা হইতে গৃহীত।

 চন্দ্রাবতীর রামায়ণের ভাষা যেমন সহজ তেমনি সুন্দর। একটি নির্ম্মল জলপ্রবাহের মত সেই কবিত্ব অবাধ গতিতে ছুটিয়াছে। কোন স্থানে বহ্বাড়ম্বর কিংবা ভাষা-পল্লবের বাহুল্যে সেই গতির বিঘ্ন সাধিত হয় নাই। সর্ব্বত্র করুণ রসের একটি মধুর ঝঙ্কার আছে। সীতার কষ্টে সেই রস উথলিয়া উঠিয়াছে। নিজের জীবনে প্রণয়ভঙ্গজনিত দারুণ ব্যথায় সীতার দুঃখ বর্ণনা করিতে যাইয়া তিনি এতটা দুঃখার্দ্র হইয়াছেন। মাইকেলের লেখায় সরমার নিকট সীতা পঞ্চবটীর যে বর্ণনা দিয়াছিলেন, অবিকল তদ্রূপ বর্ণনা সীতা অযোধ্যায় তাঁহার সখী দিগকে দিয়াছেন।