পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৫৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৪৪
পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা

গল্পটি বাঙ্গালা পল্লীর নিজস্ব, অথচ ইহা কর্ম্মপুরুষের আবির্ভাব দ্বারা কতকটা ব্রাহ্মণ্য-প্রভাবান্বিত হইয়াছে। খাস দেশী গল্পে যদি-বা কোন অলৌকিক কিছু থাকে তাহা কোন সিদ্ধ পুরুষের কাণ্ড। কিন্তু এই কর্ম্মপুরুষটি হিন্দুর দেবতার মত। ইঁহার কৃপায় ফকির রাজা হইতেছেন এবং ভ্রূকুটিতে রাজা পুনরায় ফকিরের ঝুলি গ্রহণ করিতেছেন। ইনি ভক্তের নিকট অসম্ভব ও উৎকট রকমের দান চাহিয়া তাহার ভক্তির পরীক্ষা করিতেছেন। রাজা তিলকবসন্ত নিজের দুইটি চক্ষু কাটারি দিয়া কাটিয়া কর্ম্মপুরুষকে উপহার দেওয়ার পর তবে রাজা তাহার প্রসন্নতা লাভ করিয়াছিলেন। পৃথিবীর যাবতীয় সুখসম্পদ্—তাহা ব্রাহ্মণের বরে লাভ হয় এবং যত কিছু দুঃখ, বিপদ্-গ্লানি—তাহা ব্রাহ্মণের অভিশাপের ফল; সংস্কৃত-প্রভাবান্বিত বাঙ্গালী কবিরা এই শিক্ষাই জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করিয়াছিলেন। ইঁহারা শিখাইয়াছিলেন, চন্দ্রের কলঙ্ক, সমুদ্রের জলের লবণত্ব, বিষ্ণুবক্ষে পদাঘাতের চিহ্ন, কৌরব ও যদুবংশ-ধ্বংস এ সমস্তই ব্রাহ্মণের অভিশাপের ফল। কর্ম্মপুরুষের প্রভাব ইহাদের অপেক্ষা কোনও অংশে কম নহে। ব্রাহ্মণ আসিলে তাঁহাকে পাদ্যঅৰ্ঘ্য দিয়া পূজা করিতে হয়, ব্রাহ্মণ্যসাহিত্যের এই চিরন্তন রীতি আমরা এই পালাটিতেও দেখিতেছি। পল্লীগানে সচরাচর এই ভাবের ব্রাহ্মণ্য-ভক্তি বড় দেখা যায় না, যদিও বাঙ্গালী গৃহস্থমাত্রই এই ভাবের সঙ্গে এখন সম্পূর্ণ পরিচিত।

 যদিও ব্রাহ্মণ্য-প্রভাবের চিহ্ন এই পালাতে অনেক স্থলে দৃষ্ট হয়, তথাপি পল্লীর সরলতা ও সৌন্দর্য্য ইহাতে যথেষ্ট পরিমাণে রক্ষিত হইয়াছে। তিলকবসন্তের রাণী ঠিক পল্লী-নায়িকা নহেন। তিনি বিবাহিতা পত্নী। তাঁহার এবং তাঁহার সপত্নীর কষ্ট-সহিষ্ণুতা, ধৈর্য্য প্রভৃতি গুণ অসামান্য। ইহা সত্ত্বেও আমাদের বলা উচিত যে এই দুইটি মহিলা হিন্দুরই সতীর আদর্শ ইঁহাদের স্বামিভক্তি এবং পাতিব্রত্য সীতা, সাবিত্রীকে স্মরণ করাইয়া দেয়। পল্লী-নায়িকাদের স্বভাব-সুলভ লীলামাধুরী অপেক্ষা স্বামিভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রদৰ্শন করাই কবির বেশী লক্ষ্য ছিল। আমরা এই দুই রাজ্ঞীর আদর্শ ব্রাহ্মণ্য-প্রভাবান্বিত স্বীকার করিয়াও এ কথা কখনই বলিব না যে চরিত্রের মাহাত্ম্য হিসাবে কবি তাঁহার কাব্যনায়িকা-