তখন কঙ্কের বয়স দশ এবং গৰ্গকন্যা লীলার বয়স আট বৎসর। রঘুসুত লিখিয়াছেনঃ—
“অষ্ট না বছরের লীলা মায়ে হারাইয়া।
বুঝিল কঙ্কের দুঃখ নিজ দুঃখ দিয়া॥”
কারণ কঙ্ক এইবার লইয়া তিনবার মাতৃহারা হইয়াছে। এই সহানুভূতি ও সাহচর্য্যের দরুন কঙ্ক ও লীলার মধ্যে যে প্রীতি হইয়াছিল তাত “গঙ্গাসম সুনির্ম্মল।” কিন্তু এই প্রীতি তাহদের জীবনে কালস্বরূপ হইয়াছিল। শৈশব-অতীতে কঙ্ক তাহার অপূর্ব্ব বাঁশীর সুরে যেরূপ সকলের মনোহরণ করিত, তেমনি তাহার কবিত্ব-শক্তিও সর্ব্বত্র পরিচিত হইয়াছিল। এই সময়ে তিনি ‘মলয়ার বারমাসী’ প্রণয়ন করেন। ঐ বিপ্রপুর গ্রামে এক মুসলমান ফকির আসিলেন, তাহার সঙ্গে পাঁচটি সাকরেদ বা শিষ্য। পীর সেইখানে একটি দরগা স্থাপন করিলেন। তদ্দেশবাসী লোকেরা পীরের নানারূপ হেকমতের পরিচয় পাইল। যে সকল রোগী তাঁহার কাছে আসিত, তিনি ধূলিপড়া দিয়া তাহাদিগকে নীরোগ করিতেন। মুখ না খুলিতেই আগস্তুকের মনের ভাব সমস্ত নিজে কহিয়া দিতেন। মাটি দিয়া মেওয়া প্রস্তুত করিয়া বালকগণের মধ্যে বিতরণ করিতেন, তাহারা তাহাতে অমৃতের স্বাদ পাইত। তাঁহার কাছে যে যাহা মানত্ করিত তাহাতেই সিদ্ধিলাভ করিত। সুতরাং সেই দেশে পীরের নাম খুব জাহির হইয়া পড়িল। বহুদূর হইতে নানা লোক তাঁহাকে দর্শন করিতে আসিত এবং তাঁহার দরগায় সিন্নিদান করিত। কিন্তু,
“সিন্নির কণিকা মাত্র পীর নাহি খায়।
গরীব দুখীরে সব ডাকিয়া বিলায়।”
অদূরে কঙ্ক ধেনু চরাইতে চরাইতে যে বাঁশী বাজাইত, তাহা পীরের মর্ম্মে মর্ম্মে প্রবেশ করিত এবং তিনি এই মনস্বী বালকের সঙ্গে পরিচিত হইবার জন্য মনে মনে অভিলাষী হইলেন। সেই মনের আহ্বানে কঙ্কও সাড়া দিল। সে নিজে হইতে তথায় আসিয়া পীরের চরণে লুটাইয়া পড়িল। পীরের কাছে বসিয়া সে যখন তাহার রচিত ‘মলয়ার বারমাসী’ গান করিত, তখন পীরের চক্ষু জলে ভাসিয়া যাইত। কালক্রমে কঙ্ক পীরের এতটা বশীভূত