পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

৩। কাঞ্চনমালা। (৭৮―১২০ পূঃ)

 “কাঞ্চনমালার” পালাটা রূপকথা। আমার ইংরেজীতে লেখা কথা-সাহিত্য (Folk Literature of Bengal) নামক পুস্তকে কাঞ্চনমালার পালা সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা আছে। রূপকথা-সাহিত্যে মালঞ্চমালার কাহিনী কবিত্বে, পবিত্রতার মাহাত্ম্যে ঘটনাসন্নিবেশনৈপুণ্যে এবং আধ্যাত্মিকতায় এক অপূর্ব্ব সামগ্রী, কাঞ্চনমালার গল্পটিও সেই সকল গুণে ঐশ্বর্য্যশালী এবং তাহাদের সঙ্গে এক পঙ‌্ক্তিতে স্থান পাইবার যোগ্য। কাঞ্চনমালা পালাটি চন্দ্রকুমার মরিচালীগ্রামের হরচন্দ্র বর্ম্মা ও আইথরনিবাসী রামকুমার মিস্ত্রীর নিকট হইতে সংগ্রহ করিয়া পাঠান। এই গদ্যপদ্যময় গীতিকথাটিকে আমি পনেরটি অধ্যায়ে বিভক্ত করিয়াছি।

 এই কাহিনীর কয়েকটি দৃশ্য ভুলিবার নহে। কাঠুরিয়াদের বনে কাঞ্চনমালার বাস তাহদের একটি। সেখানকার বনবাস ও লতাকুঞ্জ তাঁহার পিতার রাজপ্রাসাদের মহিমাকে পরিম্লান করিয়া দিয়াছে। সেই যে রূপসী যুবতী শিশুস্বামীকে ক্রোড়ে করিয়া, কাঠ মাথায় বহিয়া পথে চলিতেছেন,―গাছের ফল কুড়াইয়া তাহাকে খাওয়াইতেছেন; তাহার শিশু স্বামী কখনও বা কাঠুরিয়া বালকদের সঙ্গে খেলিতেছে―দুঃখের মধ্যে সে কি সুখের জীবন! বনবাসের মধ্যে সে কি সুখের গৃহবাস! এই মনোরম দৃশ্য পাঠকের মানসপটে চির অঙ্কিত থাকিবার যোগ্য। ‘ মত হস্তী যেমন সরোবর মন্থন করিয়া সরোরূহ উৎপাটন করিয়া লইয়া যায়, তেমনই রাজদস্যু আসিয়া সেই প্রশান্ত বনস্থলীকে নিষ্ঠুর ভাবে পীড়ন করিয়া শিশুটিকে লইয়া গেল। সে কি নিদারুণ শোক রমণীর বুকে হানা দিয়া তাঁহার এই নিবিড় বনকুঞ্জের বাস তুলিয়া দিল! কোথাও লেংটা কুকী মানুষের মাংস খায়, কোথায় গাড়ো পাহাড়ের ঝরণার তীরে মানুষ সাপ ও বাঘের সঙ্গে একত্র বাস করে, সেই সকল দুর্গম বনস্থলী ও গিরিগুহা কাঞ্চনের হাহাকারে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল।