পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২
পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা

শাসিত বর্ত্তমান হিন্দু সমাজের মত আদৌ নহে। ইহা ব্রাহ্মণাধিকারের পূর্ব্ববর্ত্তী চিত্র কিংবা মগদিগের সমাজের প্রতিচ্ছায়া, তাহা ঠিক বোঝা যাইতেছে না। রাজবংশী, কোচ প্রভৃতি জাতিদের উপরে মগদিগের প্রভাব কম ছিল না। সুতরাং এই চিত্রগুলি মগ প্রভাবের দ্বারা চিহ্নিত বলিয়া সময়ে সময়ে মনে হয়। এই পালাগানটিতে বাণিজ্যসংক্রান্ত সে সকল কথা আছে, তাহা স্পষ্টতঃ এই দেশের খুব প্রাচীন কালের, সুতরাং পালাগানটি খুব প্রাচীন বলিয়া বোধ হয়। ইহার মধ্যে আদৌ মুসলমানী প্রভাব নাই।

 বিবাহের নিয়ম অত্যন্ত শিথিল ছিল। মদন সাধু ও ভেলুয়া বহুকাল স্বামী-স্ত্রীভাবে বসবাস করার পর ধনঞ্জয় সাধু তাহার পুত্ত্র হিরণ সাধুর সঙ্গে ভেলুয়ার বিবাহ অনুমোদন করিতেছেন (১৭৩ পৃঃ ১৩-১৬ ছত্র)। একটি পলাতকা কুমারী সপ্তদর্শবর্ষ বয়সের সময় প্রণয়ীর সঙ্গে বহুস্থলে পর্য্যটন করিয়া এবং নানাস্থানে অত্যাচারী ব্যক্তিদিের অন্তঃপুরে আবদ্ধ থাকার পর যখন পিত্রালয়ে ফিরিয়া আসিলেন, তখন তিনি সদয় ভাবে গৃহীত হইলেন। ইহা কি খুব বিচিত্র প্রথা নহে? ভেলুয়া এবং মেনকা উভয়েই সপ্তদশবর্ষ অতিক্রম করিয়া প্রণয়ি-মনোনয়ন করিতেছেন (১৩৪ পৃঃ, ৩য় ছত্র)। এই সমাজে ব্রাহ্মণদিগের বিশেষ কোন গৌরবজনক স্থান ছিল বলিয়া মনে হয় না। বিবাহ ব্যাপারটা প্রায় সমস্তই স্ত্রী-আচার। বিবাহোৎসবে যে দান এবং ভোজনাদি ব্যাপারের বর্ণনা আছে, তাহাতে দরিদ্রভোজনের উল্লেখ আছে, কিন্তু ব্রাহ্মণভোজনের কথা নাই (২০৬ পৃঃ, ১০৩ ছত্র)।

 যদিও স্ত্রী স্বাধীনতার ভূরি ভূরি প্রমাণ প্রায় প্রতি পত্রেই পাওয়া যায়, তথাপি এইটিই খুব সুখের বিষয় যে কোন স্থানেই হিন্দুরমনীর অনাবিল পবিত্রতার ব্যত্যয় হয় নাই। সহস্র উৎপীড়ন এবং উৎকট পরীক্ষা সত্ত্বেও সাধ্বী নায়িকারা তাঁহাদের নারীধর্ম্ম অটুট রাখিয়াছেন। যাহা সমাজের নিতান্ত ব্যাভিচার বলিয়া নিন্দনীয় হইতে পারিত, এই শুভ্র পবিত্রতার আলোকে তাহা একান্তরূপে উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। বিবাহের সমাজনীতি এই নায়িকারা উল্লঙ্ঘন করিয়াছেন; কিন্তু হৃদয়ের একনিষ্ঠ প্রেমে তাঁহাদের তিলমাত্রও দোষ বর্ত্তে নাই।