পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
৩৩

চাউনি এড়াইতে পারিতেন না। স্বামী শত চেষ্টা করিলেও দৃষ্টি সংযমিত করিতে পারিতেন না। এমতাবস্থায় যে একটি মাত্র উপায় ছিল, মধুমালা তাহাই অবলম্বন করিলেন—অর্থাৎ সর্ত্তের নির্দ্দিষ্ট কাল—বার বৎসরের জন্য স্বামীকে ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন।

 এই দীর্ঘকাল কত দুঃখ, কত বিপদ, কত উৎকট পরীক্ষার মধ্যে পড়িয়া স্বামীকে প্রতি ধাপে ধাপে অলক্ষিত ভাবে ধ্বংসের মুখ হইতে বাঁচাইয়া মধুমালা শেষে স্বর্গে চলিয়া গেলেন; যেন প্রখর একখানি তারোয়াল খেলিতে খেলিতে চোখ ধাঁধিয়া চলিয়া গেল; রমণীর অসাধারণ প্রতিভা যেন বিঘ্ন-সঙ্কুল তিমিরাবৃত একটি রাজ্যকে ক্ষণতরে আলোকিত করিয়া চলিয়া গেল। খর বিদ্যুদ্দামের মত তাঁহার রূপ, ততোধিক তাঁহার প্রত্যুতপন্নমতিত্ব, ততোধিক সংযম—যেন আমাদিগকে একটি স্বর্গের ছবি দেখাইয়া হঠাৎ নিবিয়া গেল।

 কিন্তু এই রূপকথায় এত বড় সাজ-সরঞ্জাম থাকা সত্বেও ইহা শিশুদিগেরই বেশী উপযোগী করা হইয়াছে। ইহার রস তরল হইয়া ছড়াইয়া পড়িয়াছে—আজগুবির অরণ্যে উদ্‌ভ্রান্ত হইয়া গিয়াছে; তাহা পুষ্ট হইয়া কাব্যশ্রীমণ্ডিত চাইতে পারে নাই। কিন্তু তথাপি সেই শৈশবশ্রুত “স্বপ্নে দেখিলাম মধুমালার রূপ রে” আমাদের মনে অফুরন্ত রসের ধারা খুলিয়া দেয়। শৈশবে কতবার রাস্তায় রাস্তায় কৃষক কণ্ঠোচ্চারিত “স্বপ্ন যদি মিথ্যা হত, তার আংটি কেন আমায় দিত”—এই সুরতরঙ্গ কাণে আসিয়া পৌঁছিত। পূর্ব্ববঙ্গের পুরাতন যুগের শিশুরা মধুমালার কাহিনী লইয়া মাতোয়ারা ছিল। এই খাঁটি বাঙ্গালা রূপকথাটি আমাদিগকে অনেক বড় বড় কাব্যকে মনে করাইয়া দিবে। বেহুলার মত মধুমালা ডুমুনী সাজিয়া ‘খারীবিউণী’ বিক্রয়ের ছলে পিত্রালয়ে গিয়াছিল। তা’র মা যখন তা’কে চিনি চিনি করিয়াও চিনিতে পারেন নাই, অথচ ব্যাকুলভাবে তাহাকে ধরিয়া রাখিতে চাহিতেছিলেন, তখন সে ব্যঙ্গের স্বরে বলিয়াছিল; যিনি মা হইয়া মেয়েকে চেনেন না, এমন মায়ের কাছে থাকিয়া কি হইবে? (৩০৭পৃঃ) এবং স্বামী যখন তাহাকে দেখিয়া “নাক মুখ তোমার মতন, তোমার মতন চেহারা। চিন্যা নাহি চিন্‌তে নারি বার বচ্ছর ছাড়া।” বলিয়া বিলাপ করিতেছিলেন, তখন ছদ্মবেশিনী ডুমুনী মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিয়া ফেলিয়াছিল,