পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
৬৩

পরিবারের সহিত সম্বন্ধবিচ্ছিন্ন হইয়াছেন, এখন সেই সমস্ত পরিবারের বংশতালিকা সংগ্রহ করা সম্ভবপর নহে। সুরতাং যদি আদম ও বিরামের কোনও সন্তানসন্ততি জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে, তাহা হইলেও পূর্ব্বোক্ত অসুবিধার জন্য তাঁহাদের বংশধরদিগের নাম ও পরিচয় সংগ্রহ করা এখন কতকটা দুঃসাধ্য দাঁড়াইয়াছে। কিন্তু আমি পূর্ব্বেও বলিয়াছি একথা সত্য যে, আদম ও বিরাম ইশাখাঁর সোণামণির গর্ভজাত সন্তান এবং তাঁহাদের মাতা মুসলমান কর্ত্তৃক অপহৃতা হইয়া জহরব্রতপালন অথবা অন্য উপায়ে আত্মহত্যা না করায় তাঁহাদের মাতামহ কেদার রায় ক্রুদ্ধ হইয়া নিরপরাধ বালকদিগের প্রতি আজীবন বিদ্বেষভাব পোষণ এবং তাঁহাদিগের প্রতি প্রতিহিংসা সাধনের বহু চেষ্টা করিয়ছিলেন।[১]

  1. স্বরূপচন্দ্র রায় মহাশয় তাঁহার ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দের প্রকাশিত সুবর্ণগ্রামের ইতিহাসে সোণামণির সম্বন্ধে এক কৌতূহলজনক বিবরণ দিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন, চাঁদ রায়ের কোনও বিশ্বাসঘাতক কর্ম্মচারী ইশাখাঁর নিকট হইতে উৎকোচগ্রহণ করিয়া সোণামণিকে হরণ করিতে তাঁহাকে সাহায্য করে। রায় মহাশয় লিখিয়াছেন, এই ব্যাপার লইয়া চাঁদ রায়ের ইশাখাঁর সহিত বহু যুদ্ধ ও রক্তপাত সঙ্ঘটিত হয়। চাঁদ রায় ইশাখাঁর কলাইগাছি দুর্গ ও তাঁহার পূর্ব্বতন রাজধানী খিজিরপুর সহরের ধ্বংস করেন। ইহাতে আরও লিখিত হইয়াছে যে, ইশাখাঁর মৃত্যুর পর চাঁদ রায় জঙ্গলবাড়ী নগর আক্রমণ করেন এবং নানাবিধ উপায়ে দেওয়ান পরিবারের প্রতি প্রতিহিংসা সাধনের প্রয়াস পাইয়াছিলেন। উক্ত ইতিহাস বলিতেছেন যে সোণামণির জীবনান্তের ইতিহাসটি বিষাদময়। ব্রহ্মদেশীয়গণ তাঁহার রাজত্ব আক্রমণ করিলে তিনি হাজিপুর দুর্গে অশ্রিয় গ্রহণ করেন; আক্রমণকারীরা সেই দুর্গ ও অবরোধ করেন, তিনি তাঁহাদিগের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করেন; কিন্তু আত্মরক্ষার উপায় নাই দেখিয়া শত্রুহস্তে পতিত হইবার আশঙ্কায় অগ্নিপ্রবেশ করেন। রায় মহাশরের মতে, ত্রিপুরারাজ এবং বিক্রমপুরের কেদার রায়—ইশাখাঁর মৃত্যুর পর এই জঙ্গলবাড়ী আক্রমণ ও লুণ্ঠন ব্যাপারে ব্রহ্মদেশীয়দিগের সহিত যোগদান করেন। আমরা রাজমালার উক্তি হইতে প্রমাণ করিয়াছি, ইশাখাঁ এক সময়ে রাজা অমরমাণিক্যের প্রধান মিত্রশক্তি ছিলেন। পরে ইশাখাঁ এবং ত্রিপুরারাজের মধ্যে মনোমালিন্য ঘটিয়াছিল। তাহার একটি বিশেষ প্রমাণ এই যে,—ইশাখাঁ এক সময়ে ত্রিপুরারাজের সপক্ষে যে তুমুল সংগ্রাম করিয়াছিলেন, ময়মনসিংহের পালারচকগণ সে কথার আদৌ উল্লেখ করেন নাই; তাঁহারা ইশাখাঁর সহিত ত্রিপুরা রাজের সমস্ত সম্বন্ধই বিলোপ করিবার চেষ্টা পাইয়াছেন। সুবর্ণগ্রামের ইতিহাসের মতে, আদম ও বিরামের কোনও সন্তানসন্ততি হয় নাই। অন্যান্য দুই একটি ঐতিহাসিক বিবরণের ন্যায়। এই ইতিহাসেও পাইতেছি, সোনামণি চাদ রায়ের কন্যা ছিলেন, ভগ্নী নহেন।