পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৮
পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা

“মলুয়া”, “চন্দ্রাবতী”তে যে সহজ সরল সৌন্দর্য্য ও ভাষার অবাধ গতি পাই, ইহাতে তাহা দৃষ্ট হয় না। সেখ ফৈজুর বর্ণনা অনেক স্থলে একঘেঁয়ে ও বাহুল্যদোষ-দুষ্ট হইয়া পড়িয়াছে। বিশেষতঃ বিভিন্ন অধ্যায়ে পরস্পর বিরোধী বর্ণনা দ্বারা কবি সামঞ্জস্য বোধের অভাবের পরিচয় দিয়াছেন। তিনি একস্থলে বলিয়াছেন, বানিয়াচঙ্গ হইতে দক্ষিণ ভাগ সাত দিনের পথ, অন্যত্র পাঁচ দিনের পথ, আবার শেষের দিকে বলিয়াছেন, দেওয়ান আলাল দক্ষিণভাগের রাজাকে বার ঘণ্টার মধ্যে হাজির করিবার জন্য আদেশ দিতেছেন। একস্থলে মক্ক। সহরকে বাণিয়াচঙ্গ হইবে ছয় মাসের পথ, অন্যত্র দিল্লীনগরীকেও সমান ব্যবধানে অবস্থিত, বলা হইয়াছে। তবে এই সমস্ত উক্তি মূর্খ গায়েনের স্মৃতি ভ্রংশের দরুণ ভুলও হইতে পারে; একটা বৃহৎ পালার রচয়িতার পক্ষে এরূপ প্রমাদ কতকট। অস্বাভাবিক বলিয়া মনে হয়।

 পূর্ব্বেই বলিয়াছি, আখ্যানটির প্রারম্ভ-ভাগ সম্ভবতঃ উপকথা হইতে গৃহীত, এবং পালাটি উপকথা ও ইতিহাসের সংমিশ্রনে রচিত। কিন্তু উপকথা রচনাতেও সম্পুর্ণ স্বেচ্ছাচার চলে না। এক জায়গায় কথিত হইয়াছে, তেড়া-লেঙ্গড়া একদিনে “হাইলাবনে” চলিয়া গিয়াছিল; আবার এই “হাইলাবন”ই ছ’মাসের পথ, বলিয়া অন্যত্র উক্ত হইয়াছে। এইরূপ গরমিল উপকথায়ও অমার্জ্জনীয়। তবে সর্ব্বদাই আমাদের মনে রাখিতে হইবে যে এই পালাগান গুলি নিরক্ষর কৃষক কবির রচিত এবং অক্ষর জ্ঞানহীন গায়েনের দ্বারা গীত হইত। সুতরাং অসামঞ্জস্য গুলি অস্বাভাবিক নহে।

 কবির আর একটি দোষ, পুনরুক্তি,—একই ভাবের কথার পুনঃ পুনঃ অবতারণা করা। যথা, কোনও দুর্ঘটনা ঘটিলে সমস্ত রাজ্যে একটা শোকের উচ্ছ্বাস হওয়া চাই। স্ত্রীপুরুষ সকলকেই আর্ত্তনাদ করিয়া কাঁদিতে হইব। পক্ষীরা পর্য্যন্ত কাকলী দ্বারা শোক প্রকাশ করিবে; অশ্বশালায় অশ্ব এবং হস্তিশালায় হস্তীও নীরবে অশ্রুবিসর্জ্জন করিবে। এইরূপ বর্ণনা আলালের মক্কাযাত্রা কালে একবার পাওয়া যায়, তরুণ জামালকে দিল্লী প্রেরণ কালেও এইরূপ শোকোচ্ছাস-বর্ণনা আছে। আবার আখ্যায়িকা পরিসমাপ্তির দিকে আলালের চিরতরে নগর পরিত্যাগ কালে এই একই দৃশ্যেরই অবতারণা করা হইয়াছে।