পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
৭৯

 পূর্ব্বেই বলিয়াছি, মৈমনসিংহের অন্যান্য পালাগানের মত এই রচনায় তেমন কবিত্ব সম্পদ নাই। তবে ঐতিহাসিকতার দিক্ দিয়া বিচার করিলে এই পালাটির কতকটা মূল্য আছে; মুসলমান আমলের সমাজ সম্বন্ধে অনেক কথার সন্ধান আমরা এই পালার ভিতর দিয়া পাইতেছি। পালার যে সমস্ত নিষ্ঠুর র শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা উল্লিখিত হইয়াছে, তাহা অতিরঞ্জিত নহে। স্বল্পকারণে নগর ও গ্রাম ধ্বংসকরণ এবং অধিবাসীদিগকে হত্যা করার আদেশ প্রদান হইতে আমর। বুঝিতে পারি, সেকালে স্বেচ্ছাচারী শাসনকর্ত্তাদের হস্তে দেশ কিরূপ নিঃসহায় ছিল। সাধারণের রাজ্যশাসন ব্যাপারে কোনই হাত ছিলনা। সুতরাং বহু অত্যাচার উৎপীড়ন সাধারণকে নীরবে সহ্য করিতে হইত। দুই এক স্থলে নিতান্ত অসহ্য হইলে একটা আশ্রয় পাইলে তাহারা ভয়ে ভয়ে রাজার বিদ্রোহাচরণ করিয়াছে।

 চন্দ্রকুমার পালাকর্ত্তা ফৈজু ফকিরের বিরূদ্ধে অভিযোগ করিয়াছেন যে তিনি হিন্দু-কন্যাকে মুসলমানের প্রণয়াকাঙ্ক্ষিণীরূপে বর্ণনা করিয়া অন্যায় করিয়াছেন। কিন্তু কবি এখানে হিন্দুবিদ্বেষের দ্বারা পরিচালিত হইয়া একথা লিখিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। জামাল খাঁ হিন্দু রাজকন্যাকে বিবাহ করিবার প্রস্তাব করায় হিন্দুরাজার যে ক্রোধের বর্ণনা আছে, তাহাতে আদৌ মুসলমানীভাবের চিহ্ন নাই, নিরপেক্ষ লেখকের মতই কবি উভয় শ্রেণীর কথাগুলি বলিয়া গিয়াছেন। অধুয়া সুন্দরীর নিকট জামাল যে প্রেমপত্র প্রেরণ করেন, তাহার ভাষাও শিষ্টতানুমোদিত ও সংযত। পালারম্ভে কবি হিন্দু মুসলমান উভয়েরই মঙ্গল কামনা করিয়াছেন; সুতরাং হিন্দুকন্যার মুসলমানের প্রতি প্রণয়-কাহিণী বর্ণনা করিয়া তিনি হিন্দুবিদ্বেষের পরিচয় দেন নাই। অনঙ্গদেবের রাজত্বে জাতি ও ধর্ম্মগত ব্যবধানের কোনও মূল্য নাই, কবির কথায় শুধু ইহাই প্রমাণিত হইয়াছে।

 এই প্রসঙ্গে আর একটি বিষয় বলিতে চাই। ‘তেড়ালেঙ্গড়া’ নামটি সংস্কৃত প্রভান্বিতযুগের পূর্ব্বকার বাঙ্গালা সাহিত্যে সচরাচর দৃষ্ট হয়। ময়নামতীরগান, ধর্ম্মমঙ্গল, এমন কি কোন কোন মনসামঙ্গলেও এই নামটা পাওয়া যায়। এই নামের দ্বারা বোধ হয় এমন এক শ্রেণীর অনুচরদিগকে বুঝাইত, যাহাদের অন্তঃপুরে স্বচ্ছন্দ-গতায়াত ছিল। তেড়া (টেরা) শব্দটী