পাতা:পূর্ব-বাংলার গল্প - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

যৌবনে জমিদারি তত্ত্বাবধানের ভার লইয়া বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলের জীবনযাত্রার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে পরিচয় তাহা এই কালে রচিত তাঁহার কোনো কোনো গল্পের উৎস, ছিন্নপত্রে তাহার উল্লেখ সুপরিচিত। বাংলাদেশের গ্রামজীবনের এই অভিজ্ঞতা রবীন্দ্রনাথের আরো কোনো কোনো গল্পে প্রতিবিম্বিত।

 বর্তমান গ্রন্থে এই গল্পগুলি সংকলিত হইল।

 ছিন্নপত্রের পাঠকের নিকট এই গল্পগুলি রচনার পটভূমি সুবিদিত— এখানে, এই পর্বের জীবনযাত্রার যে বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ উত্তরকালে দিয়াছেন সুত্ররূপে তাহা উদ্বৃত হইল (শ্রীপ্রভাতচন্দ্র গুপ্ত, “প্রভাত-রবি”, প্রবাসী, বৈশাখ ১৩৪৪)—

“শিলাইদহে পদ্মার··· বোটে ছিলাম আমি একলা, সঙ্গে ছিল এক বুড়ো মাঝি, আমার মত চুপচাপ প্রকৃতির, আর ছিল এক চাকর, ফটিক তার নাম। সেও স্ফটিকের মতই নিঃশব্দ। নির্জনে নদীর বুকে দিন বয়ে যেত নদীর ধারারই মত সহজে। বোট বাঁধা থাকত পদ্মার চরে। সেদিকে ধু-ধু করত দিগন্ত পর্যন্ত পাণ্ডুবর্ণ বালুরাশি, জনহীন, তৃণশষ্যহীন। মাঝে মাঝে জল বেধে আছে, সেখানে শীত ঋতুর আমন্ত্রিত জলচর পাখির দল। নদীর ওপারে গাছপালার ঘন ছায়ায় গ্রামের জীবনযাত্রা। মেয়েরা জল নিয়ে যায়, ছেলেরা জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটে— চাষীরা গোরু মোষ নিয়ে পার হয়ে চলে অন্য তীরের চাষের ক্ষেত্রে, মহাজনী নৌকা গুণের টানে মন্থর গতিতে চলতে থাকে, ডিঙি-নৌকা পাটকিলে রঙের পাল উড়িয়ে হু-হু করে জল চিরে যায়, জেলে-নৌকা জাল বাচ করতে থাকে, যেন সে কাজ নয়, যেন সে খেলা, এর মধ্যে প্রজাদের প্রাত্যহিক সুখদুঃখ আমার গোচরে এসে পড়ত তাদের নানাপ্রকার নালিশ নিয়ে, আলোচনা নিয়ে। পোস্ট্ মাস্টার গল্প শুনিয়ে যেত গ্রামের সত্য ঘটনা এবং তার নিজের সংকট সমস্যা নিয়ে, বোষ্টমী এসে আশ্চর্য লাগিয়ে যেত তার রহস্যময় জীবনবৃত্তান্ত বর্ণনা ক’রে। বোট ভাসিয়ে চলে যেতুম, পদ্মা থেকে পাবনার কোলের ইছামতীতে, ইছামতী থেকে বড়লে হুড়োসাগরে, চলনবিলে, আত্রাইয়ে, নাগর নদীতে, যমুনা পেরিয়ে সাজাদপুরের খাল বেয়ে সাজাদপুরে। দুই ধারে কত টিনের-