পাতা:প্রবন্ধ সংগ্রহ - প্রমথ চৌধুরী.pdf/৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

68 প্ৰবন্ধসংগ্ৰহ যায় তা বৈজ্ঞানিক সত্য নয়। বিজ্ঞানের যা-কিছৰ মযাদা গৌরব ও মালা, তা সবই এই পদ্ধতির দরন। আমাদের কাছে কোনো বৈজ্ঞানিক সত্যের বিশেষ কিছ মাল্য নেই, যদি আমরা কি উপায়ে সেটি পাওয়া গেছে তা না জানি। পথিবী কমলালেবর মতো, এটি হচেছ বৈজ্ঞানিক সত্য। কিন্তু কি মাপজোখের কি যান্তির সাহায্যে এই সত্য নিণীত হয়েছে, সেটি না জানলে ও-সত্য আমাদের মনের হাতে কমলালেব নয়, ছেলের হাতে মোয়া ; অর্থাৎ তা আমাদের এতই কম করায়ত্ত যে, যে-খাঁশি-সেই কেড়ে নিতে পারে। বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তসকলের ক্ৰমান্বয় ভুল বেরচেছ, আবার তা সংশোধন করা হচেছ। কিন্তু সে ভুলের আবিস্কার ও সংশোধন ঐ একই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে সাধিত হচেছ। ঐতিহাসিক শাখার নেতা শ্রীযক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্ৰেয় মহাশয় ঐতিহাসিক সত্য নিৰ্ণয় করবার পদ্ধতিটি যে কি, তারই বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেছেন; কারণ ইতিহাস ঠিক বিজ্ঞান না হলেও একটি উপবিজ্ঞানের মধ্যে গণ্য। এ ক্ষেত্রে মৈত্ৰেয়মহাশয়ের মতে ঐতিহাসিকদের প্রধান কতব্য হচেছ অন্যাসন্ধান করে অতীতের দলিল সংগ্ৰহ করা। সে দলিল নানা দেশে নানা স্থানে ছড়ানো আছে। সতরাং সেই-সব হারামণির অন্বেষণের জন্য ঐতিহাসিকদের দেশদেশান্তরে ঘরতে হবে। শােধ তাই নয়। ঐতিহাসিক তত্ত্ব সকল সময়ে মাটির উপর পড়ে-পাওয়া যায় না। ও হচেছ বেশির ভাগ কন্টে করে উদ্ধার করবার জিনিস। কারণ অতীত প্রত্যক্ষ নয়, বতমানে তা ঢাকা পড়ে থাকে। ঐতিহাসিক তত্ত্ব আবিস্কার করবার অর্থ হচ্ছে অ-দলটিকে দন্ডট করা, তার জন্য চাই পরিষকার। তাই মৈত্ৰেয়মহাশয় কেবলমাত্ৰ ভক্তিভরে অতীতের নাম কীন্তন না করে তার সাক্ষাৎকার লাভ করবাব পরামর্শ আমাদের দিয়েছেন। তাঁর পরামর্শমত কাজ করতে হলে আমাদের করতাল ভেঙে কোদাল গড়াতে হবে। ভুগভের্স ও কালগভে যে-সকল ঐতিহাসিক রত্ন নিহিত আছে আগে তা খড়ে বার করতে হবে, পরে তার কাটাই-ছাঁটাই করে সাহিত্যসমাজে প্রচলন করতে হবে। এ কথা অবশ্যস্বীকার্য যে, আগে আসে খনিকার, তার পরে মণিকার। মৈত্ৰেয়মহাশয় তাই ঐতিহাসিকদের কলম ছাড়িয়ে খন্তা ধরাতে চান। তাঁর বিশ্ববাস যে, ঐতিহাসিকদের হাতের খন্তা নিয়ত ব্যবহারে ক্ষয়ে গিয়ে ক্রমশ কলমের আকার ধারণ করবে, এবং সেই কলমে ইতিহাস লিখতে হবে। ইতিহাসের আবিক্ষকতা ও রচয়িতার মধ্যে যে অধিকারভেদ আছে, মৈত্ৰেয়মহাশয় বোধ হয় সেটি মানেন না। অথচ এ কথা সত্য যে একজনের পক্ষে কলম ছেড়ে খলতা ধরা যত কঠিন, আর-একজনের পক্ষে খন্তা ছেড়ে কলম ধরা তার চাইতে কিছর কম কঠিন সে যাই হোক, মৈত্ৰেয়মহাশয় আমাদের আর-একটি বিশেষ আবশ্যকীয় কথা সমরণ করিয়ে দিয়েছেন। সে হচ্ছে এই যে, ত্যাগ সম্বীকার না করতে পারলে কোনোরাপ সাধনা করা যায় না। কেননা, ত্যাগের অভ্যাস থেকেই সংযমের শিক্ষা লাভ করা যায়। ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক সাধনা করতে হলে আমাদের অসংখ্য মানসিক-আলস্যপ্রসন্ত বিশ্ববাস ত্যাগ করতে হবে। আমাদের পরাণের মায়া, কিংবদন্তীর মোহ কাটাতে হবে।