ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ হইতে শেষ পর্য্যন্ত বাঙ্গলা ভাষা ও সাহিত্য কোন কোন মহাত্মার চেষ্টায় কিরূপ দ্রুততর উন্নতিমার্গে চলিয়াছিল তাহা ঐ একশত বৎসরের মোটামুটী সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনা করিলেই বুঝিতে পারা যাইবে।
১৮০২ খৃষ্টাব্দে রামরাম বসুর “লিপিমালা” এবং তাহার কিছু পরেই তৎকৃত ‘রাজাবলী’ প্রকাশিত হয়। ইহার পূর্ব্বে ইনি “প্রতাপাদিত্যচরিত” নামক একখানি পুস্তক লিখিয়াছিলেন। এই তিনখানাই ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম গদ্য-সাহিত্য। পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের “প্রবোধচন্দ্রিকা” ইহার পূর্ব্বে রচিত হয়। “তোতা ইতিহাস” তাহারও পূর্ব্বে। সুতরাং রামরাম বসুই ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম গদ্য-সাহিত্য-লেখক। তাঁহার “লিপিমালার” ভাষা—“তোমাদের মঙ্গল সমাচার অনেক দিন পাই নাই। তাহাতে ভাবিত আছি। চিরকাল হইল তোমার খুল্লতাত, গঙ্গা পৃথিবীতে আগমন হেতু প্রশ্ন করিয়াছিলেন, তখন তাহার বিশেষণ প্রাপ্ত হইতে পারেন নাই।” রাজাবলীর ভাষাঃ—“শকাদি পাহাড়ী রাজার অধর্ম্ম ব্যবহার শুনিয়া উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্য সসৈন্যে দিল্লীতে আসিয়া শকাদিত্য রাজার সহিত যুদ্ধ করিয়া তাহাকে যুদ্ধে মারিয়া আপনি দিল্লীতে সম্রাট হইলেন।”
১৮০৪ খৃষ্টাব্দে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের “বত্রিশ সিংহাসন” রচিত হয়। তাহার ভাষাঃ—“একদিবস রাজা অবন্তীপুরীতে সভামধ্যে দিব্য সিংহাসনে বসিয়াছেন, ইতোমধ্যে এক দরিদ্র পুরুষ আসিয়া রাজার সম্মুখে উপস্থিত হইল, কথা কিছু কহিল না।”
উক্ত বিদ্যালঙ্কার মহাশয়ের “প্রবোধচন্দ্রিকার” ভাষা কিন্তু “বত্রিশ সিংহাসনের” মত সরল বা সুখবোধ্য নহে। বিকট সংস্কৃতের অনুকরণে উৎকট ভাষায় লিখিতঃ—“কোকিল কলালাপবাচাল, যে মলয়ানিল, সে উচ্ছলচ্ছীকরাত্যচ্ছ নির্ঝরারমভঃ কণাচ্ছন্ন হইয়া আসিতেছে।”
তার পর ১৮১১ খৃষ্টাব্দে “কৃষ্ণচন্দ্র চরিত” রচিত হয় এবং লণ্ডনে মুদ্রিত হইয়া প্রকাশিত হয়। রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় ইহার রচয়িতা। কৃষ্ণচন্দ্র চরিতের ভাষা—“পরে নবাব মোহনদাসের বাক্য শ্রবণ করিয়া ভয়যুক্ত হইয়া সাবধানে থাকিয়া মোহনদাসকে পঁচিশ হাজার সৈন্য দিয়া অনেক আশ্বাস করিয়া পলাশীতে প্রেরণ করিলেন।” দীনেশবাবু যে বলিয়াছেন “কৃষ্ণচন্দ্র চরিতের ভাষা খাঁটী বাঙ্গলা, ইহার উপর ইংরাজী গদ্যের কোন ভাব দেখা যায় না” তাহা ঠিক। বোধ হয় “কৃষ্ণচন্দ্র চরিতই” খাঁটী বাঙ্গলা ভাষার প্রথম গদ্য-সাহিত্য। ঠিক এই সময়ে বা কিছু পরে রামজয় তর্কালঙ্কার কর্ত্তৃক “সাংখ্য ভাষ্য”, লক্ষ্মীনারায়ণ ন্যায়ালঙ্কার কর্ত্তৃক “মিতাক্ষরা” ও কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন কর্ত্তৃক “ন্যায়দর্শন” বঙ্গভাষায় লিখিত হয়।
এই সময়ে কলেজের বাঙ্গলা পাঠ্য ছিল মৃতুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের “পুরুষ পরীক্ষা” “হিতোপদেশ” প্রভৃতি। বিদ্যালঙ্কার, তর্কালঙ্কার প্রভৃতি দেখিয়া পাঠকগণ অবশ্যই বুঝিতে পারিতেছেন যে, সংস্কৃতজ্ঞবড়লাট লর্ড হার্ডিং-এর নামে “বিদ্যাকল্পদ্রুম” উৎসৃষ্ট হইয়াছিল। সেই উৎসর্গপত্রের ভাষা দেখিলেই শত বৎসর পূর্ব্বের মাসিক পত্রের অবস্থা ও ভাষা কতকটা বুঝিতে পারা যাইবেঃ—“গৌড়ীয় ভাষাতে ইউরোপীয় বিদ্যার অনুবাদ যত বাঞ্ছনীয় তত সহজ নহে, অতএব অসাধ্য জ্ঞান করিয়া আমি অনেক দিন পর্য্যন্ত এ চেষ্টাতে বিরত ছিলাম; কিন্তু সম্প্রতি কেবল গবর্ণমেণ্ট সমীপে উৎসাহ পাইয়া উক্ত অনুবাদের প্রতিজ্ঞাতে পুনশ্চ প্রবৃত্ত হইলাম।”
এই সময়ে উক্ত দেশীয় পাদরীর “ষড়দর্শন সংগ্রহ” গ্রন্থ এবং ডাক্তার রাজেন্দ্রলালের “বিবিধার্থ সংগ্রহ” নামক মাসিক পত্র প্রকাশিত হয়। বিবিধার্থ সংগ্রহের ভাষা—“আমরা পল্লিবাসীজনের প্রতি অমর্ষাম্বিত হইয়া দুর্ব্বল পরামর্শ পক্ষের উল্লেখ করিতেছি; কিন্তু তাহাই যে সর্ব্বত্রেরই রীতি হউক এমন আমাদের অভিসন্ধি নহে।” এই বিবিধার্থ সংগ্রহ ভিন্ন ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল “রহস্য সন্দর্ভ,” “পত্র কৌমুদী,” “শিবাজীর জীবনী,” “মিবারের ইতিহাস” প্রভৃতি অনেক গ্রন্থ লিখিয়া গিয়াছেন। ইনি, বাঙ্গলা, সংস্কৃত, হিন্দী, পার্সী, ঊর্দ্দূ, ইংরাজী, গ্রীক্, লাটীন, ফরাসী, জার্ম্মান প্রভৃতি বহুবিধ ভাষায় ব্যুৎপন্ন ছিলেন।
এইরূপে ক্রমশঃ উন্নতিলাভ করিয়া ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বঙ্গসাহিত্য বিশেষ প্রকারে শ্রীসম্পন্ন হইয়াছিল। এই সময়ে পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার বঙ্গভাষার উন্নতিসাধনে সবিশেষ যত্নপর হয়েন। তাঁহার “শিশুশিক্ষা” তিন ভাগ প্রকাশিত হইয়া প্রথম শিক্ষার্থী বাঙ্গালী বালকগণের বিশেষ উপকারে আইসে। মদনমোহন “সর্ব্ব শুভঙ্করী” নাম্নী একখানা মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত করেন। এতদ্ব্যতীত তাঁহার রচিত “রসতরঙ্গিণী”, “বাসবদত্তা” প্রভৃতি পদ্যকাব্য তৎকালে বঙ্গ সাহিত্যের শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছিল।
ইহার পরই গুপ্ত কবির কাল। সে সময় কবিবর ঈশ্বর গুপ্ত বাঙ্গলা সাহিত্যে কিরূপ প্রভাব সম্পন্ন হইয়াছিলেন তাহা বঙ্কিমবাবু প্রভৃতি তাঁহার শিষ্যগণের প্রভাবেই পরিলক্ষিত হইতে পারে।