পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/১২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

RR8 অধৈর্য্য হইয়া মনে করি সেটা হয় তাহদের ইচ্ছাকৃত অন্ধতার ভান, নয় আমাদের শত্রুপক্ষ তাহাদিগকে মাতৃবিদ্রোহে উত্তেজিত করিয়াছে। কিন্তু আমরাই যে মাকে দেশের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করি নাই এই অপরাধটা আমরা কোনমসেই নিজের স্বন্ধে লইতে রাজি নহি । ছাত্রকে মাষ্টার পড়া বুঝাইয়া দেয় নাই, বুঝাইবার ক্ষমতাও তাহার নাই, অথচ ছাত্র যখন পড়া বলিতে পারে না তখন রাগিয়া তাহাকে মারিতে যাওয়া যেমন এও তেমনি। আমরাই দেশের সাধারণ লোককে দূরে রাখিয়াছি, অথচ প্রয়োজনের সময় তাহারা দূরে থাকে বলিয়া আমরাই রাগ করি! অবশেষে যাহারা আমাদের সঙ্গে স্বাভাবিক কারণেই যোগ দিতে পারে নাই, যাহারা বরাবর যে পথে চলিয়া আসিতেছিল সেই চিরাভ্যস্ত পথ হইতে হঠাৎ ইংরাজি পড়া বাবুদের কথায় সরিতে ইচ্ছা করিল না আমরা অনেক স্থলেই যথাসাধ্য তাহদের প্রতি বল প্রয়োগ করিয়াছি, তাহাদিগকে পরাস্ত করিবার জন্য আমাদের জেদ বাড়িয়া গিয়াছে। আমরা নিজেকে এই বলিয়া বুঝাইয়াছি যাহার আত্মহিত বুঝে না, বলপূৰ্ব্বক তাহাদিগকে আত্মহিতে প্রবৃত্ত করাইব। আমাদের দুর্ভাগ্যই এই, আমরা স্বাধীনতা চাই কিন্তু স্বাধীনতাকে আমরা অন্তরের সহিত বিশ্বাস করি না। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি শ্রদ্ধা রাখিবার মত ধৈৰ্য্য আমাদের নাই ;—আমরা ভয় দেখাইয়া তাহার বুদ্ধিকে দ্রুতবেগে পদানত করিবার জন্য চেষ্টা করি। পিতৃপুরুষকে নরকস্থ করিবার ভয়, ধোবা নাপিত বন্ধ করিবার শাসন, ঘরে অগ্নিপ্রয়োগ বা পথের মধ্যে ধরিয়া ঠেঙাইয়া দিবার বিভীষিকা, এ সমস্তই দাসবৃত্তিকে অস্তরের মধ্যে চিরস্থায়ী করিয়া দিবার উপায়-কাজ ফাকি দিবার পথ বঁাচাইবার জন্য আমরা যখনি এই সকল উপায় অবলম্বন করি তখনি প্রমাণ হয়, বুদ্ধির ও আচরণের স্বাধীনতা যে মানুষের পক্ষে কি অমূল্য ধন তাহা আমরা জানিনা। আমরা মনে করি আমার মতে সকলকে চালানই সকলের পক্ষে চরম শ্রেয় অতএব সকলে যদি সত্যকে বুঝিয়া সে পথে চলে তবে ভালই, যদি না চলে তবে ভুল বুঝাইয়াও চালাইতে হইবে অথবা চালনার সকলের চেয়ে সহজ উপায় আছে জবরদস্তি । প্রবাসী । [ ৮ম ভাগ। বয়কটের জেদে পড়িয়া আমরা এই সকল সংক্ষিপ্ত উপাi. অবলম্বন করিয়া হিতবুদ্ধির মূলে আঘাত করিয়াছি তাহান্তে সন্দেহ নাই। অল্পদিন হইল মফস্বল হইতে পত্র পাইয়াছি সেখানকার কোন একটি বড় বাজারের "লোকে নোটিশ পাইয়াছে যে যদি তাহারা বিলাতী জিনিষ পরিত্যাগ করিয়া দেশ জিনিষের আমদানী না করে তবে নির্দিষ্ট কালের মেয়াদ উত্তীর্ণ হইলেই বাজারে আগুন লাগিবে। সেই সঙ্গে স্থানীয় নিকটবৰ্ত্তী জমিদারদের আমলাদিগকে প্রাণহানিঃ ভয় দেখানো হইয়াছে। এইরূপ ভাবে নোটিশ দিয়া কোথাও কোথাও আগুন লাগানো হইয়াছে। ইতিপূৰ্ব্বে জোর করিয়া মাল আমদানি বন্ধ করিবার চেষ্টা হইয়াছে এবং খরিদদারদিগকে বলপূৰ্ব্বক বিলাতী জিনিষ খরিদ করিতে নিরস্ত করা হইয়াছে। ক্রমে এখন সেই উৎসাহ ঘরে আগুন লাগানো এবং মানুষ মারাতে আসিয়া পৌছিয়াছে। দুঃখের বিষয় এই যে, এইরূপ উৎপাতকে আমাদের দেশের অনেক ভদ্রলোক আজও অন্যায় বলিয়া মনে করিতে ছেন না—তাহারা স্থির করিয়াছেন দেশের হিতসাধনের উপলক্ষ্যে এরূপ উপদ্রব করা যাইতে পারে। ইহঁদের নিকট ন্যায়ধৰ্ম্মের দোহাই পাড়া মিথ্যা - ইহারা বলেন মাতৃভূমির মঙ্গলের জন্য যাহা করা যাইবে তা অধৰ্ম্ম হইতে পারে না। কিন্তু অধৰ্ম্মের দ্বারা যে মাতৃভূমি । মঙ্গল কখনই হইবে না সে কথা বিমুখ বুদ্ধির কাছেও বারবার বলিতে হইবে। জিজ্ঞাসা করি, বাজারে আগুন লাগাইয়া অথবা অনিচ্ছুক লোকের মাথা ভাঙিয়া যদি আমরা বিলাতী কাপড় ছাড়াইয়া একদল লোককে দেশী কাপড় ধরাই তবে বাহিরে মাত্র দেশী কাপড় পরাইয়া ইহাদের সমস্ত অন্তঃকরণকে কি স্বদেশীর বিরুদ্ধে চিরদিনের জন্য বিদ্রোহী করিয়া তুলি না ? দেশের যে সম্প্রদায়ের লোক স্বদেশী প্রচারের ব্রত লইয়াছেন র্তাহাদের প্রতি এই সকল লোকের বিদ্বেষকে কি চিরস্থানী করা হয় না ? এইরূপ ঘটনাই কি ঘটতেছে না ? “যাহারা কখনো বিপদে আপদে মুখে দুঃখে আমাদিগকে স্নেহ করে নাই, আমাদিগকে যাহারা সামাজিক ব্যবহারে পশুর অপেক্ষা অধিক - _ ঘূণা করে তাহারা আজ কাপড় পরানো বা অন্য যে কোনো উপলক্ষ্যে আমাদের প্রতি জবরদস্তি প্রকাশ করিবে, ইহা সহ করিব না" দেশের নিম্নশ্রেণীর মুসলমান এবং নমশুদ্রের মধ্যে এইরূপ অসহিষ্ণুতা জাগিয়া উঠিয়াছে। ইহারা জোর করিয়া, এমন কি, ক্ষতি স্বীকার করিয়াও বিলাতী সামগ্ৰী ব্যবহার করিতেছে । তাই বলিতেছি, বিলাতী দ্রব্য ব্যবহারই দেশের চরম অহিত নহে, গৃহবিচ্ছেদের মত এত বড় অহিত আর কিছুই নাই। দেশের একপক্ষ প্রবল হইয়া কেবলমাত্র জোরের দ্বারা অপর ক্ষীণ পক্ষকে নিজের মত-শৃঙ্খলে দাসের মত আবদ্ধ করিবে ইহার মত ইষ্টহানিও আর কিছুতে হইতে পারে না। এমন করিয়া, বন্দে মাতরম্ মন্ত্র উচ্চারণ করিলেও মাতার বন্দন করা হইবে না–এবং দেশের লোককে মুখে ভাই বলিয়া কাজে ভ্রাতৃদ্রোহিত করা হইবে। সবলে গল। টিপিয়া ধরিয়া মিলনকে মিলন বলে না,—ভয় দেখাইয়া, এমন কি, কাগজে কুৎসিত গালি দিয়া মতের অনৈক্য নিরস্ত করাকেও জাতীয় ঐক্য সাধন বলে না। এ সকল প্রণালী দাসত্বের প্রণালী। যাহার এইরূপ উপদ্রবকে দেশহিতের উপায় বলিয়া প্রচার করে তাহারা স্বজাতির লজ্জাকর হীনতারই পরিচয় দেয় এবং এই প্রকার উৎপাত করিয়া যাহাদিগকে দলন দমন করিয়া দেওয়া যায় তাহাদিগকেও হীনতাতেই দীক্ষা দেওয়া হয়। সেদিন কাগজে দেখিতেছিলাম, মর্লিকে যখন বলা হইয়াছিল যে প্রাচ্যগণ কোনো প্রকার আপসে অধিকার প্রাপ্তির মূল্য বোঝে না –তাহারা জোরকেই মানে— তখন তিনি বলিয়াছিলেন, তাহা হইতে পারে কিন্তু আমরা ত প্রাচ্য নই আমরা পাশ্চাত্য । কথাটা শুনিয়া মনের মধ্যে আক্ষেপ বোধ হইয়াছিল। আক্ষেপের কারণ এই যে আমাদের ব্যবহারে আমরা প্রাচ্যদের বিরুদ্ধে এই গুরুতর অপবাদের সমর্থন করিয়া থাকি। হাতে কোনো প্রকার ক্ষমতা পাইবামাত্র অন্তকে জোরের দ্বারা অভিভূত করিয়া চালনা করিবার অতি হীনবুদ্ধিকে আমরা কিছুতে ছাড়িতে চাহি না । যেখানে আমরা মুখে স্বাধীনতা চাই সেখানেও আমরা নিজের কর্তৃত্ব অন্যের প্রতি অবৈধ বলের সহিত খাটাইবার প্রবৃত্তিকে খৰ্ব্ব করিতে পারি না। উহার প্রতি জোর না থাটাইলে উহার মঙ্গল হইবে না অতএব যেমন করিয়া পারি আমাকে উহার উপরে কৰ্ত্ত হইতে হইবে। হিতানুষ্ঠানেরও উপায়ের দ্বারা আমরা মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করি এবং এই প্রকার অশ্রদ্ধার ঔদ্ধত্য দ্বারা আমরা নিজের এবং অন্ত পক্ষের মনুষ্যত্বকে নষ্ট করিতে থাকি । যদি মানুষের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা থাকে তবে লোকের সছুপায় । RRQ ঘরে আগুন লাগানো এবং মারধোর করিয়া গুণ্ডামি করিতে আমাদের কদাচই প্রবৃত্তি হইবে না ; তবে আমরা পরম ধৈৰ্য্যের সহিত মানুষের বুদ্ধিকে হৃদয়কে, মানুষের ইচ্ছাকে মঙ্গলের দিকে ধৰ্ম্মের দিকে আকর্ষণ করিতে প্রাণপাত করিতে পারিব। তখন আমরা মানুষকেই চাহিব, মানুষ কি কাপড় পরিবে বা কি মুন খাইবে তাহাকেই সকলের চেয়ে বড় করিয়া চাহিব না। মানুষকে চাহিলে মানুষের সেবা করিতে হয়, পরস্পরের ব্যবধান দূর করিতে হয়—নিজেকে নম্র করিতে হয়। মানুষকে যদি চাই তবে যথার্থভাবে মানুষের সাধন করিতে হইবে ; তাহাকে কোনো মতে আমার মতে ভিড়াইবার আমার দলে টানিবার জন্ত টানাটানি মারামারি না করিয়া আমাকে তাহার কাছে আত্মসমর্পণ করিতে হইবে। সে যখন বুঝিবে আমি তাহাকে আমার অনুবর্তী অধীন করিবার জন্য বলপূৰ্ব্বক চেষ্টা করিতেছি না-আমি নিজেকে তাহারই মঙ্গল সাধনের জন্ত উৎসর্গ করিয়াছি তখনি সে বুঝিবে আমি মানুষের সঙ্গে মনুষোচিত ব্যবহারে প্রবৃত্ত হইয়াছি--তখনি সে বুঝিবে বন্দে মাতরম্ মন্ত্রের দ্বার আমরা সেই মাকে বন্দনা করিতেছি দেশের ছোটবড় সকলেই যাহার সন্তান, তখন মুসলমানষ্ট কি আর নমশুদ্রই কি, বেহারী উড়িয়া অথবা অন্য যে কোনো ইংরাজি শিক্ষায় পশ্চাদ্বত্তী জাতিই কি, নিজের শ্রেষ্ঠতার অভিমান লইয়া কাহাকেও ব্যবহারে বা বাক্যে বা চিন্তায় অপমানিত করিব না। তখনি সকল মানুষের সেবা ও সন্মানের দ্বারা, যিনি সকল প্রজার প্রজাপতি, তাহার প্রসন্নত এই ভাগ্যহীন দেশের প্রতি আকর্ষণ করিতে পারিব। নতুবা, আমার রাগ হইয়াছে বলিয়াই দেশের সকল লোককে আমি রাগাইয়া তুলিব, অথবা আমি ইচ্ছা করিতেছি বলিয়া দেশের সকল লোকের ইচ্ছাকে আমার অনুগত করিব ইহা কোনো বাগিতার দ্বারা কদাচ ঘটবে না। ক্ষণকালের জন্ত একটা উৎসাহের-উত্তাপ জাগাইয়া তুলিতে পারি কিন্তু তাহা সত্যকার ইন্ধনের অভাবে কখনই স্থায়ী হইতে পারিবে না। সেই সত্য পদার্থ মানুষ ;–সেই সত্য পদার্থ মানুষের হৃদয় বুদ্ধি, মানুষের মনুষ্যত্ব ; স্বদেশী মিলের কাপড় অথবা করকচ লবণ নহে। সেই মানুষকে প্রত্যহ অপমানিত করিয়া মিলের কাপড়ের পূজা করিতে থাকিলে আমরা দেবতার বর পাইৰ না ; বরঞ্চ উল্ট ফলই পাইতে থাকিব। একটি কথা আমরা কখনো ভুলিলে চলিবে না যে, অন্যায়ের দ্বারা অবৈধ উপায়ের দ্বারা কার্য্যোদ্ধারের নীতি অবলম্বন করিলে কাজ আমরা অল্পই পাই অথচ তাহাতে করিয়া সমস্ত দেশের বিচারবুদ্ধি বিকৃত হইয়া যায়। তখন কে কাহাকে কিসের দোহাই দিয়া কোন সীমার মধ্যে