পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/১৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

| ২৩৮ হইবে—আগামী কাল আটটা আন্দাজ সময়ে সেখানে পৌছিবে । হারান বাবু উত্তেজিত হইয়া উঠিয়া বিনয় ও গোরাকে নিন্দা করিতে আরম্ভ করিলেন। স্বচরিতা তাড়াতাড়ি চৌকি হইতে উঠিয়া পাশের ঘরে প্রবেশ করিয়া বেগে দ্বার ভেজাইয়া দিল। একটু পরেই ললিতা দ্বার ঠেলিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। দেখিল, স্বচরিতা দুইহাতে মুখ ঢাকিয়া বিছানার উপর পড়িয়া আছে। ললিতা ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়া ধীরে ধীরে সুচরিতার পাশে বসিয়া তাহার মাথায় চুলের মধ্যে আঙুল বুলাই দিতে লাগিল। অনেকক্ষণ পরে স্বচরিত যখন শাস্ত হইল তখন জোর করিয়া তাহার মুখ হইতে বাহুর আবরণ মুক্ত করিয়া তাহার মুথের কাছে মুখ লইয়৷ গিয়া কানে কানে বলিতে লাগিল—“দিদি, আমরা এথান থেকে কলকাতায় ফিরে যাই, আজ ত ম্যাজিষ্ট্রেটের ওখানে যেতে পারব না।” স্বচরিতা অনেকক্ষণ এ কথার কোনো উত্তর করিল না। ললিতা যখন বার বার বলিতে লাগিল তখন সে বিছানায় উঠিয়া বসিল—“সে কি করে হবে ভাই ? আমার ত একেবারেই আসবার ইচ্ছা ছিল না—বাবা যখন পাঠিয়ে দিয়েছেন তখন, যে জন্তে এসেছি তা না সেরে যেতে পারব না ।” ললিত কহিল—“বাবাত এসব কথা জানেন না— জানলে কখনই আমাদের থাকতে বলতেন না।” স্বচরিতা কহিল, “তা কি করে জানব ভাই !" ললিতা। দিদি, তুই পারবি ? কি করে যাবি বল দেখি ? তার পরে আবার সাজগোজ করে ষ্টেজে গড়িয়ে কবিতা আওড়াতে হবে! আমার ত জিভ ফেটে গিয়ে রক্ত পড়বে তবু কথা বের হবে না ! স্বচরিত কহিল—“সে ত জানি বোন। কিন্তু নরকযন্ত্রণাও সইতে হয়। এখন আর কোনো উপায় নেই! আজকের দিন জীবনে আর কখনো ভুলতে পারব না।” সুচরিতার এই বাধ্যতায় ললিতা রাগ করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল। মাকে আসিয়া কহিল— “মা তোমরা যাবে না ?” প্রবাসী । ৮ম ভাগ। বরদাসুন্দরী কহিলেন,-“তুই কি পাগল হয়েছিল। রাত্তির নটার পর যেতে হবে।” ললিত কহিল—“আমি কলকাতায় যাবার কথা বলুচি। বরদাসুন্দরী। শোন একবার মেয়ের কথা শোন! ললিতা স্বধীরকে কহিল, "সুধীর-দ, তুমিও এখানে থাকবে ?” গোরার শাস্তি স্বধীরের মনকে বিকল করিয়া দিয়া ছিল কিন্তু বড় বড় সাহেবের সম্মুখে নিজের বিদ্যা প্রকাশ করিবার প্রলোভন সে ত্যাগ করিতে পারে এমন সাধা তাহার ছিল না। সে অব্যক্তস্বরে কি একটা বলিলবোঝা গেল সে সঙ্কোচ বোধ করিতেছে কিন্তু সে থাকিয়াই যাইবে । বরদাসুন্দরী কহিলেন, “গোলমালে বেলা হয়ে গেল। আর দেরি করলে চলবে না। এখন সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত বিছানা থেকে কেউ উঠতে পারবে না -বিশ্রাম করতে হবে। নইলে ক্লান্ত হয়ে রাত্রে মুখ শুকিয়ে যাবেদেখতে বিত্র হবে।” এই বলিয়া তিনি জোর করিয়া সকলকে শয়নম্বরে পূরিয়া বিছানায় শোওয়াইয়া দিলেন। সকলেই ঘুমাই পড়িল কেবল স্বচরিতার ঘুম হইল না এবং অন্ত ঘরে ললিতা তাহার বিছানার উপরে উঠিয়া বসিয়া রহিল। ষ্টীমারে ঘন ঘন বঁাশি বাজিতে লাগিল । ষ্টীমার যখন ছাড়িবার উদ্যোগ করিতেছে, থালাসীরা সিড়ি তুলিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছে এমন সময় জাহাজের ডেকের উপর হইতে বিনয় দেখিল একজন ভদ্রস্ত্রীলোক জাহাজের অভিমুখে দ্রুতপদে আসিতেছে। তাহার বেশ ভূষা প্রভৃতি দেখিয়া তাহাকে ললিতা বলিয়াই মনে হুইল কিন্তু বিনয় সহসা তাহা বিশ্বাস করিতে পারিল না। অবশেষে ললিত নিকটে আসিতে আর সন্দেহ রহিল না। একবার মনে করিল ললিতা তাহাকে ফিরাইতে আসিয়াছে কিন্তু ললিতাই ত ম্যাজিষ্ট্রেটের নিমন্ত্রণে যোগ দেওয়ার বিরুদ্ধে দাড়াইয়াছিল। ললিতা ষ্টীমারে উঠিয়া পড়িলখালাসী সিড়ি তুলিয়া লইল। বিনয় শঙ্কিতচিত্তে উপরের ডেক হইতে নীচে নামিয়া ললিতার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। ললিত কহিল, "আমাকে উপরে নিয়ে চলুন।" - ৫ম সংথ্যা । ] বিনয় বিস্মিত হইয়া কহিল, “জাহাজ যে ছেড়ে দিচ্ছে!” ললিত কহিল, "সে আমি জানি।” বলিয়া বিনয়ের as অপেক্ষ না করিয়াই সন্মুখের সিড়ি বাহিয়া উপরের छलाग्न डे*िग्र। ८१० ।। ষ্টীমার বাশি ফুকিতে ফুকিতে ছাড়িয়া দিল । বিনয় ললিতাকে ফাষ্টক্লাসের ডেকে কেদারায় বসাইয়। নীরব প্রশ্নে তাহার মুখের দিকে চাহিল । ললিত কহিল—“আমি কলকাতায় কিছুতেই থাকতে পারলুম না।” বিনয় জিজ্ঞাসা করিল—“ওঁরা সকলে জানেন ?” ললিত কহিল—“এখনো পৰ্য্যন্ত কেউ জানেন না। মানি চিঠি রেখে এসেছি—পড়লেই জানতে পারবেন।” ললিতার এই দুঃসাহসিকতায় বিনয় স্তম্ভিত হইয়া গেল। সঙ্কোচের সহিত বলিতে আরম্ভ করিল—“কিন্তু—” ললিতা তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া কহিল—“জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে এখন আর ‘কিন্তু নিয়ে কি হবে! মেয়ে মানুষ হয়ে জন্মেছি বলেই যে সমস্তই চুপ করে সহ করতে হবে সে আমি বুঝিনে। আমাদের পক্ষেও ন্তায় অন্যায় সম্ভব অসম্ভব আছে। আজকের নিমন্ত্রণে গিয়ে অভিনয় করার চেয়ে আত্মহত্যা করা আমার পক্ষে সহজ।" বিনয় বুঝিল, যা হইবার তা হইয়া গেছে, এখন এ কাজের ভালমন্দ বিচার করিয়া মনকে পীড়িত করিয়া তোলায় কোনো ফল নাই । কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয় ললিতা কছিল, “দেখুন আপনার বন্ধু গৌরমোহন বাবুর প্রতি আমি মনে মনে বড় অবিচার করেছিলুম। জানিনে, প্রথম থেকেই কেন তাকে * দেখে তার কথা শুনে আমার মনটা তার বিরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি বড় বেশি জোর দিয়ে কথা কইতেন, আর আপনার সকলেই তাতে যেন সায় দিয়ে যেতেন—তাই দেখে আমার একটা রাগ হতে থাকৃত। আমার স্বভাবই ঐ— আমি যদি দেখি কেউ কথায় বা ব্যবহারে জোর প্রকাশ | Hಡ್ সে আমি একেবারেই সইতে পারিনে। কিন্তু গৌরমোহন বাবুর জোর কেবল পরের উপরে নয় সে তিনি নিজের উপরেও খাটান—এ সত্যিকার জোর -এরকম যাব—আমি l মানুষ আমি দেখিনি।” গোরা । ミ○s এমনি করিয়া ললিতা বকিয়া যাইতে লাগিল। কেবল যে গোরা সম্বন্ধে সে অনুতাপ বোধ করিতেছিল বলিয়াই এ সকল কথা বলিতেছিল তাহা নহে ; আসলে, কোকের মাথায় যে কাজটা করিয়া ফেলিয়াছে তাহার সঙ্কোচ মনের ভিতর হইতে কেবলি মাথা তুলিবার উপক্রম করিতেছিল ; -কাজটা হয়ত ভাল হয় নাই এই দ্বিধা জোর করিবার লক্ষণ দেখা যাইতেছিল ; বিনয়ের সম্মুখে ষ্টীমারে এইরূপ একলা বসিয়া থাকা যে এত বড় কুষ্ঠার বিষয় তাহা সে পূৰ্ব্বে মনেও করিতে পারে নাই ; কিন্তু লজ্জা প্রকাশ হইলেই জিনিষটা অত্যন্ত লজ্জার বিষয় হইয়া উঠিবে এইজন্ত সে প্রাণপণে বকিয়া যাইতে লাগল। বিনয়ের মুপে ভাল করিয়া কথা জোগাইতেছিল না। এদিকে গোরার দুঃখ ও অপমান, অন্ত দকে সে যে এখানে ম্যাজিষ্ট্রেটের বাড়ি আমোদ করিতে আসিয়াছিল তাহার লজ্জা, তাহার উপরে ললিতার সম্বন্ধে তাহার এই অকস্মাৎ অবস্থাসঙ্কট, সমস্ত একত্র মিশ্রিত হইয়া বিনয়কে বাক্যহীন করিয়া দিয়াছিল। পূৰ্ব্বে হইলে ললিতার এই দুঃসাহসিকতায় বিনয়ের মনে তিরস্কারের ভাব উদয় হইত—আজ তাহা কোনো মতেই হইল না। এমন কি, তাহার মনে যে বিস্ময়ের দয় হইয়াছিল তাহার সঙ্গে শ্রদ্ধা মিশ্রিত ছিল-ইহাতে আরো একটি আনন্দ এই छ्नि তাহাদের সমস্ত দলের মধ্যে গোরার অপমানের সামান্ত প্রতিকারচেষ্টা কেবল বিনয় এবং ললিতাই করিয়াছে। এজন্য বিনয়কে বিশেষ কিছু দুঃখ পাষ্টতে হইবে না, কিন্তু ললিতাকে নিজের কৰ্ম্মফলে অনেক দিন ধরিয়া বিস্তর পীড়া ভোগ করিতে হইবে। অথচ এই ললিতাকে বিনয় বরাবর গোরার বিরুদ্ধ বলিয়াই জানিত । যতই ভাবিতে লাগিল ততই ললিতার এই পরিণাম-বিচারহীন সাহসে এবং অন্তায়ের প্রতি একান্ত ঘৃণায় তাহার প্রতি বিনয়ের ভক্তি জন্মিতে লাগিল। কেমন করিয়া কি বলিয়৷ যে সে এই ভক্তি প্রকাশ করিবে তাহ ভাবিয়া পাইল না। বিনয় বারবার ভাবিতে লাগিল ললিতা যে তাছুকে এত পরমুখাপেক্ষী সাহসহীন বলিয়া ঘৃণা প্রকাশ করিয়াছে সে ঘৃণা যথার্থ। সে ত সমস্ত আত্মীয় বন্ধুর নিন্দ প্রশংসা সবলে উপেক্ষা করিয়া এমন করিয়া কোনো বিষয়েই সাহসিক আচরণের দ্বারা নিজের মত প্রকাশ করিতে পারিত না