পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/১৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

- উদ্ভাসিত মৰ্ম্মবেদনার ૨૧8 প্রকাশ করা অসম্ভব ; অত্যন্ত বিশ্বস্ত সর্থীকেও এমন কলঙ্কের আভাষ দেওয়া স্বাভাবিক নয়। তবুও মেহেরউন্নিসা আগ্রায় এক সর্থীকে ডাকিয়, সকল কথা খুলিয়৷ বলিয়া সদবুদ্ধির উপদেশ চাহিল। এই ক্ষুদ্র দৃশুটির কৌশলময় অবতারণায় কবি বুঝাইয়া দিলেন, যে মুন্দরীর অন্তরের মধ্যে এমন ঝড় বহিতেছিল, যে সে কিছুতেই আত্মরক্ষা করিতে পারিতেছিল না। ছায়া ও দুঃস্বপ্নের কথাটা, মুখ ফুটিয়া একবার বলিয়া ফেলিলে যদি লজ্জা প্রভাবে উহার ক্ষীণ হইয় পড়ে ; এই আশা । আবর্তে পড়িয়া একটা তৃণ ধরিয়া প্রাণ রক্ষার মত একবার বিশ্বস্ত সর্থীর উপদেশ ভিক্ষা ; এই মাত্র। চতুর্থ দৃশুটি পড়িয়া দেখ, উহার একটি কথায় কোন জোর নাই, রমণীর উপদেশে কিছু বিশেষত্ব নাই এবং মেহেরের প্রতিজ্ঞার মধ্যেও কোন তেজ নাই। কিন্তু গভীরভাবে পড়িলেই বুঝিতে পারা যায়, যে মুরজাহান যত বাহিক স্থিরতা দেখাইলেও তাহার মনের মধ্যে ঝড় বহিতেছিল। ব্যাধমন্ত্রে চঞ্চল বিহঙ্গিনী একবার প্রাণপণে পাথা নাড়িয়া আপনার ক্ষুদ্র নীড়ের দিকে চলিল। নিঃশব্দে অল্প কথায় এমন করিয়া অন্তরের ছবি ফুটাইয়া তোলা সহজ ক্ষমতার কথা নয়। শেরখা বুঝিয়া ফেলিলেন তাহার স্বথ গিয়াছে ; তিনি তখন মৃত্যুর আহবানে অগ্রসর হইলেন। প্রথম অঙ্কের অষ্টম দৃশ্যে এই মৰ্ম্মান্তিক কাহিনী। যে কথাগুলি কহিয়৷ শেরখা পত্নীর নিকট হইতে শেষ বিদায় গ্রহণ করিলেন, তাহা যদি স্বতন্ত্র একটি গীতি কবিতায় রচিত হইত, তবে বাঙ্গালার ঐ শ্রেণীর কবিতার ভাণ্ডারে একটি অমূল্য রত্ন সঞ্চিত রহিত। নিয়তি-প্রজ্জ্বলিত বহ্নির দীপ্ত আলোকে করুণায় সিক্ত, সেই সরস ও সুকোমল প্রীতির হতাশগীতি, অনেক বার পড়িয়াছি। উপমার ভাবব্যঞ্জকতায়, প্রতির মাধুর্য্যে এবং ধীরোদাত্তের চাঞ্চল্যহীন কাতরতায়, কবির বর্ণনা অতি চমৎকার হইয়াছে :-s আমি মানুষ-দুৰ্ব্বল মানুষ মাত্র। আর গে আমার প্রথম যৌবন, মেহের। প্রথম যৌবন! যখন আকাশ বড়ই নীল, পৃথিবী বড়ই হামল ; যখন নক্ষত্রগুলি বাসনার ফুলিঙ্গ, গোলাপ ফুলগুলি হৃদয়ের রক্ত ; যখন কোকিলের গান একটা স্মৃতি, মলয় সমীরণ একটা স্বপ্ন : [ ৮ম ভাগ । যখন প্রণয়ীর দর্শন উষার উদয়, চুম্বন সজল বিছা ! আলিঙ্গন আত্মার প্রলয়। সেই যৌবনে আমি তোমা। রূপের সুধা পান করেছিলাম।” - ইহার পর যখন শেরথ মরিয়া গেল ; তখনে যুদ্ধ জাহানের অস্তবিরোধ ছিল । পাই, যে মেহের পোষাপার্থটির মত ধরা দিয়াছিল। লয়লার সন্দেহের কারণ ছিল ; নচেৎ সে হ্যামলেটের মন্ত ক্রমাগতই হতভাগিনীর মনে পিতৃস্মৃতি জাগাইয়া দিতে আসিত কেন । কিন্তু যখন মুরজাহান পিতা ও ভ্রাতার মুখসম্পদের কথায়ও বিবাহে স্বীকৃত হইল না, কিন্তু শেষে প্রতিহিংসার স্থবিধার কথায় নূতন আলোক পাই। উৎসাহিত হইয়া উঠিল, তখন কি বালিকা লয়লার অনুমান অস্বীকার করিতে হইবে ? না। সে কথা বিস্তৃতভা৷ে পরে বগিতেছি। মুরজাহান অবশু বলিয়াছিল, যে সে শয়তানীর প্রভাব প্রায় দমন করিয়া আনিয়াছিল। কিন্তু সে কথাটা সহজ অর্থে গ্রহণ করিলে, প্রতিহিংসার জন্ম অতটা উৎসাহের ভাব বোঝা যায় না। শেরখার পী নারী বই নয় ; তাছার পক্ষে মাঝে মাঝে চরণ-তলে-নিক্ষিপ্ত ভারতরাজ্যের কথা ভাবা আশ্চৰ্য্য নয়। ইঙ্গিতে তায় বুঝিয়া লয়লাও রাগ করিতে পারে ; শেরখার মত দেবতার কথা স্মরণ করিয়া বিবাহে স্বীকৃত মুরজাহানও সে ভাবটাকে শয়তানী বলিয়া আত্মগ্লানি প্রকাশ করিড়ে পারে। কিন্তু উহার যথার্থ সিদ্ধান্ত, মনুষ্যচরিত্রের জটিলতায় অনুসন্ধান করিতে হয়। কেবল প্রতিহিংসার জন্য মুরজাহান বিবাহ করে নাই ; মুখে যাহাই বলুপ্ত, কথা তাহ নয়। মনকে যখন আমরা চোখ ঠারিয়া কাজ করি, তখন ক্ষুদ্র একটা বাহানাকেই বড় করিয়া তুলি৷ থাকি। জাহাঙ্গীর সম্বন্ধে একটি কথা বলিয়া লইয়া, পরে একথা আবার বলিতেছি । রেবা সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, পুণ্যময়ী, পতিভক্তিপরায়ণী ; কোন স্বামীর পক্ষেই স্ত্রীর এত গুণের মধ্যে, তাহার প্রতিদিনের ঘরসংসার-করা-প্রেমের অন্তরালে, গ্রেমের পুর্বরাগের মধুরতা মাখানো একটু চকচকে প্রেমের অভাব, লক্ষ্য করা সহজ নয়। কিন্তু যাহার চিত্ত প্রথম হইতেই লালসাদীপ্ত, তাহার কাছে ঐ গুণসমষ্টি লাবণ্যমান অঙ্গ । কেননা লয়লার মুখে শুনিন্তে । ৫ম সংখ্য । ਾਂ মত। প্রথমযৌবনের নবদীপ্তিতে নয়নের যে পিাদলীলা, অবগুণ্ঠনের সহসা উন্মোচনে লক্ষ্য করিয়া, ছিলেন, জাহাঙ্গীর তাহা কদাচ ভূলিতে পারেন নাই ; ভোগের তীব্র লালসায় পুণ্যময়ীর সংযত প্রেম, মুধুর হইতে পারে না। সেই জন্য এরূপ স্থলে অনেক হতাশেরা মদ ৰাষ্টয়া মরে। আমি সম্রাট, ক্ষমতাশালী ; আমি কি আমার কামাপদার্থ-উপভোগে বঞ্চিত থাকিব ? এ ভাবটিও জাহাঙ্গীরের চিত্তকে চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছিল। তাই তিনি ছলে, বলে, কৌশলে, অমানুষিক নরহত্যা পর্যন্ত করাষ্টয়া, মুরজাহান লাভ করিয়াছিলেন। লালসার প্রবল উত্তেজনায়, ভোগের গভীর সাধনায়, পাপ পুণ্য তুচ্ছ করিয়া যাহা লাভ করা যায়, মানুষ সকল স্থলেই তাহার গোলাম হইয়া থাকে। বুদ্ধিমান জাহাঙ্গীরও তাই মুরজাহানের গোলামীতে বুঝিয়া সুবিয়া আপনার ও দেশের মঙ্গল দলিত করিয়াছিলেন । এই স্বাভাবিকতার জন্তই, প্রথমতঃ জাহাঙ্গীরের ভীষণ পাপানুষ্ঠানে ক্রুদ্ধ হইয়াও পরে তাহার নিঃসহায়তা এবং পতন দেখিয়া দুঃখিত হই। কিন্তু মুরজাহান ? সেই কথাই বলিতেছি। মুরজাহানের শয়তান কি কেবল তাহার গৌরবলালসা ? এবং বিবাহে সম্মতি কি কেবল প্রতিহিংসা সাধনের সুগমতা লাভে ? পুরুষের মরণ কোথায়, প্রায় সকল রমণীই তাহা বুঝিতে পারে ; বুদ্ধিমতী মুরজাহান, উত্ৰাস্ত জাহাঙ্গীরের অবস্থা দেখিয়া স্পষ্টই বুঝিতে পারিয়াছিল, যে সম্রাটের ক্ষমতা তাহার পদতলে ; এবং ইচ্ছা করিলে সে তাহার তর্জনীসঞ্চালনে রাষ্ট্রনীতির সকল অবস্থা হেলাইতে দোলাইতে পারে। কেবল কি সেই ক্ষমতার পিপাসায় সে উত্তেজিতা ? মূলে কি ভোগলালসা ছিল না ? লয়লার অনুমান কি মিথ্যা ? এই জটিল কথা কবি অতি দক্ষতার সহিত বিশ্লেষণ করিয়াছেন ; তবে একটু বুঝিয়া লইতে হয়। কবি, শেরখাকে দেবতার মত করিয়া গড়িয়াছেন ; কিন্তু মুরজাহান তাহাকে ভক্তিই করিত, নারীর প্রাণ টালিয়া ভালবাসিত না। একথা মুরজাহান নিজেই বলিয়াছে। ইহাতে আশ্চর্য্যের বিষয় কিছুই নাই । অঙ্গরাজ অযোগ্য না হইলেও ইন্দুমতী তাহাকে গ্রহণ কৰেন নুরজাহান । नाई ;–“নাসে ন কাম্যে, নচবেদ সম্যক , দ্রষ্ট,ং ন স৷ २१¢ ভিন্নরুচিৰ্হি লোকঃ” । উল্টাদিক দিয়াও ঐ কথা। “স্বজন, সুন্দর, বীর, ছিল প্রিয়পতি,” তথাপি আর্য্য-রমণী কৃষ্ণকায় দস্থার প্রেম চাহিয়াছিল। সে বলিয়াছিল – সুন্দর আমার স্বামী, কিন্তু মুথে তার কামনা লালসা মাথা হাসি রাশি নাই ; শুধুই বৈদিক নিষ্ঠা, শুদ্ধ সদাচার, নিয়মিত হাসি কথা—আমি নাহি চাই। : একটু লালসার বাতাস না বহিলে, শুধু যৌবনগর্বে, শুধু থেয়ালে, মুখের কাপড় উড়িয়া যাইত না। কিন্তু মুরজাহান যে-সে মেয়ের মত চপল নয়, তাহার আত্মসম্মান বোধ ছিল, সে বুদ্ধিমতী ছিল ; নহিলে এতবড় রাজ্য শাসন করিতে পারিতনা । তাই সে প্রাণপণে দেবতা লইয়া ঘর সংসার করিয়া সুখী হইতে চেষ্ট করিয়াছিল। সে আত্মসন্মান রক্ষার জন্য যথেষ্ট যুদ্ধ করিয়াছিল ; কিন্তু ঘটনা তাহার অনুকুল হয় নাই। সে দেখিয়াছিল, যে ক্রমাগতই নিয়তির তাড়নায় সে যেন ফাদে পড়িতেছিল। একদিকে আত্মসম্মান রক্ষা, অন্যদিকে ভোগলালসার প্রচ্ছন্ন বহ্নি, এবং গৌরব-আকাজার বাতাস ; এস্থলে জয় পরাজত্ব কাহার হয়, তাহা বলিতে হইবে না। যাহা স্বাভাবিক, তাহাই হইয়াছিল ; এবং স্বাভাবিকতা প্রদর্শনই কাব্যের কাৰ্য্য। প্রবল আত্মসম্মান বোধ, এবং লয়লার তিরস্কার চারি বৎসর তাহাকে রক্ষা করিয়াছিল। সাহিত্যরথী বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় বলি, যে, পাপের পথ বড় পিচ্ছিল ; প্রতিপদে পতনশীলের গতিবৃদ্ধি হয়। পূর্ণ ক্ষমতা মুষ্টিগত করিবার জষ্ঠ মুরজাহান প্রতিদিন যাহা অনুষ্ঠান করিতেছিল, তাহার ভীষণতায় একদিন নিজেই , কঁপিয়া উঠিয়াছিল। নুরজাহান যে লয়লার একদিনকার হঠাৎ রাগের কথায় বড় একটা পাপকাৰ্য্য করিয়াছিল, তাহ নয় ; অনুষ্ঠিত পাপ, "প্রতিহিংসার’ নাম দিয়া ঢাকিতে গিয়া অর্থাৎ মনকে চোখ ঠারিতে গিয়া, পুণ্যময় লয়লার কথা আপনার নজীর বলিয়া খাড়া করিতে চাহিয়াছিল। অতি ক্ষুদ্র, লুকানো, নিস্তেজ পাপও একবার প্রশ্রয় পাইলে সকল পুণ্য গ্রাস করিতে পাবে ; তাই মুরজাহান বিষম আবৰ্ত্তে পড়িয়াছিল।