পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/১৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

లిం సి মাসিমার মুখে ও কণ্ঠস্বরে এমন একটি কি ছিল যাহাতে তাহার জীবনের সুগভীর শোকের আশ্রমার্জিত পবিত্র একটি আভাস প্রকাশিত হইয়া পড়িল । “আমি সতীশের মাসী হই" বলিয়া তিনি যখন সতীশকে বুকের কাছে চাপিয়া ধরিলেন তখন এই রমণীর জীবনের ইতিহাস কিছুই না জানিয়াও বিনয়ের মন করুণায় ব্যথিত হইয়া উঠিল। বিনয় বলিয়া উঠিল, "একলা সতীশের মাসিমা হলে চলবে না ; তা হলে এত দিন পরে সতীশের সঙ্গে আমার ঝগড়া হবে। একে ত সতীশ আমাকে বিনয় বাবু বলে, দাদা বলে না, তার পরে মাসিমা থেকে বঞ্চিত করবে সে ত কোনো মতেই উচিত হবে না।” মন বশ করিতে বিনয়ের বিলম্ব হইত না। এই প্রিয়দর্শন প্রিয়ভাষী যুবক দেখিতে দেখিতে মাসিমার মনে সতীশের সঙ্গে দখল ভাগ করিয়া লইল"। মাসিম জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাছ, তোমার মা কোথায় ?” বিনয় কহিল, “আমার নিজের মাকে অনেক দিন হল হারিয়েছি কিন্তু আমার মা নেই এমন কথা আমি মুখে আনতে পারব না।” এই বলিয়া আনন্দময়ীর কথা স্মরণ করিবামাত্র তাহার দুই চক্ষু যেন ভাবের বাম্পে আর্দ্র হইয়া আসিল । দুই পক্ষে কথা খুব জমিয়া উঠিল। ইহাদের মধ্যে আজ যে নুতন পরিচয় সে কথা কিছুতেই মনে হইল না। সতীশ এই কথাবাৰ্ত্তার মাঝখানে নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে মন্তব্য প্রকাশ করিতে লাগিল এবং ললিত চুপ করিয়া বসিয়া রহিল । চেষ্টা করিলেও ললিতা নিজেকে সহজে যেন বাহির করিতে পারে না। প্রথম পরিচয়ের বাধা ভাঙিতে তাহার অনেক সময় লাগে। তা ছাড়া, আজ তাহার মন ভাল ছিল না। বিনয় যে অনায়াসেই এই অপরিচিতার সঙ্গে আলাপ জুড়িয় দিল ইহা তাহার ভাল লাগিতেছিল না ; ললিতার যে সঙ্কট উপস্থিত হইয়াছে বিনয় তাহার গুরুত্ব মনের মধ্যে গ্ৰহণ না করিয়া যে এমন নিরুদ্বিগ্ন হইয়া আছে ইহাতে বুিনয়কে লঘুচিত্ত বলিয়া সে মনে মনে অপবাদ দিল। কিন্তু মুখ গম্ভীর করিয়া বিষন্নভাবে চুপচাপ বসিয়া প্রবাসী । ്.--്.------്--്. ്.-- থাকিলেই বিনয় যে ললিতার অসন্তোষ হইতে নিয়ন্তি পাইত তাহা নহে ;—তাহা হইলে নিশ্চয় ললিত রাগিা মনে মনে এই কথা বলিত - “আমার সঙ্গেই বাবার বোধ৷ পড়া, কিন্তু বিনয় বাবু এমন ভাব ধারণ করিতেছেন কেন, যেন উহার ঘাড়েই এই দায় পড়িয়াছে।” আসল কথা, কাল রাত্রে যে আঘাতে সঙ্গীত বাজিয়াছিল, আজ দিনের বেলায় তাহাতে ব্যথাই বাজিতেছে—কিছুই ঠিকমত হইতেছে না। আজ তাই ললিতা প্রতিপদে বিনয়ের সঙ্গে মনে মনে ঝগড়াই করিতেছে ; বিনয়ের কোনো ব্যবহারেই এ ঝগড়া মিটিতে পারিত না—কোন মূলে সংশোধন হইলে ইহার প্রতিকার হইতে পারিত তাহ অন্তর্যামীই জানেন। হায় রে, হৃদয় লইয়াই যাহাদের কারবার সেই মেয়েদের ব্যবহারকে যুক্তিবিরুদ্ধ বলিয়া দোষ দিলে চলিবে কেন? যদি গোড়ায় ঠিক জায়গাটিতে ইহার প্রতিষ্ঠা থাকে তবে হৃদয় এম্নি সহজে এম্নি সুন্দর চলে যে যুক্তিতর্ক হার মানিয়া মাথা হেঁট করিয়া থাকে কিন্তু সেই গোড়া ীি লেশমাত্র বিপৰ্য্যয় ঘটে তবে বুদ্ধির সাধ্য কি যে কা ঠিক করিয়া দেয়—তখন রাগবিরাগ হাসিকান্না, কি হইতে যে কি ঘটে তাহার হিসাব তলব করিতে যাওয়াই বৃথা। এদিকে বিনয়ের হৃদয়যন্ত্রটিও যে বেশ স্বাভাবিকভাবে চলিতেছিল তাহা নহে। তাহার অবস্থা যদি অবিকল পূৰ্ব্বের মত থাকিত তবে এই মূহুর্তেই সে ছুটিয়া আনন্দময়ীর কাছে যাইত। গোরার কারাদণ্ডের খবর বিনয় ছাড়া মাকে আর কে দিতে পারে! সে ছাড়া মায়ের সাত্মনাই বা আর কে আছে ! এই বেদনার কথাটা বিনয়ের মনের তলায় বিষম একটা ভার হইয় তাহাকে কেবলি পেষণ করিতেছিল—কিন্তু ললিতাকে এখনি ছাড়িয়া চলিয়া যায় ইহা তাহার পক্ষে অসম্ভব হইয়াছিল। সমস্ত সংসারের বিরুদ্ধে আজ সেই যে ললিতার রক্ষক, ললিতা সম্বন্ধে প্ররেল বাবুর কাছে তাহার যদি কিছু কৰ্ত্তব্য থাকে তাহ শেষ করিয়া তাহাকে যাইতে হইবে এই কথা সে মনকে বুঝাইতে ছিল। মন তাহ অতি সামান্ত চেষ্টাতেই বুঝিয়া লই | ছিল ; তাহার প্রতিবাদ করিবার ক্ষমতাই ছিল না। গোরা এবং আনন্দময়ীর জন্য বিনয়ের মনে যত বেদনাই থাক্ আজ ললিতার অতি সন্নিকট অস্তিত্ব তাহাকে এমন ৮ম ভাগ। | ~."...-- ৬ষ্ঠ সংখ্যা । ] ਜ ਜਿਲ - লাগিল—এমন একটা বিস্ফারতা, সমস্ত দাসারের মধ্যে এমন একটা বিশেষ গৌরব—নিজের সত্তার সে এমন একটা বিশিষ্ট স্বাতন্ত্র্য অনুভব করিতে লাগিল যে তাহার মনের বেদনাট মনের নীচের তলাতেই রহিয়া | গেল। ললিতার দিকে সে আজ চাহিতে পারিতেছিল ন=কেবল ক্ষণে ক্ষণে চোখে আপনি যেটুকু পড়িতেছিল, ললিতার কাপড়ের একটুকু অংশ, কোলের উপর নিশ্চলভাবে স্থিত তাহার একখানি হাত—মুহূর্তের মধ্যে ইহাই তাহাকে পুলকিত করিতে লাগিল । দেরি হইতে চলিল। পরেশ বাবু এখনো ত আসিলেন না। উঠবার জন্ত ভিতর হইতে তাগিদ ক্রমেই প্রবল হইতে লাগিল—তাহাকে কোনো মতে চাপা দিবার জন্ত বিনয় সতীশের মাসীর সঙ্গে একান্তমনে আলাপ করিতে থাকিল। অবশেষে ললিতার বিরক্তি আর বঁাধ মানিল না; সে বিনয়ের কথার মাঝখানে সহসা বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল—“আপনি দেরি করচেন কার জন্তে ? বাবা কথন আসবেন তার ঠিক নেই। আপনি গৌর বাবুর মার কাছে একবার যাবেন না ?” বিনয় চমকিয়া উঠিল। ললিতার বিরক্তিস্বর বিনয়ের পক্ষে সুপরিচিত ছিল। সে ললিতার মুথের দিকে চাহিয়া একমুহূর্বে একেবারে উঠিয়া পড়িল-হঠাৎ গুণ ছিড়িয়া গেলে বাণ যেমন সোজা হইয় উঠে তেমনি করিয়া সে দাড়াইল । সে দেরি করিতেছিল কাহার জন্ত ? এখানে যে তাহার কোনো একান্ত প্রয়োজন ছিল এমন অহঙ্কার ত আপন হইতে বিনয়ের মনে আসে নাই—সে ত দ্বারের নিকট হইতেই বিদায় লইতেছিল—ললিতাই ত তাহাকে অনুরোধ করিয়া সঙ্গে আনিয়াছিল—অবশেষে ললিতার মুখে હરે હતાઃ । বিনয় এমনি হঠাৎ আসন ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িয়াছিল যে, ললিত বিস্মিত হইয় তাহার দিকে চাহিল । দেখিল, বিনয়ের মুখের স্বাভাবিক সহান্ততা একেবারে এক ফুৎকারে প্রদীপের আলোর মত সম্পূর্ণ নিবিয়া গেছে। বিনয়ের এমন ব্যথিত মুখ, তাহার ভাবের এমন অকস্মাৎ পরিবর্তন ললিতা আর কখনো দেখে নাই। বিনয়ের মুথের দিকে চাহিয়াই তীব্র অনুতাপের জালাময় কষাঘাত তৎক্ষণাৎ SAMMMMMM MMSMMSMSMSMSMS ○ 2○ ললিতার হৃদয়ের একপ্রাস্ত হইতে আর একপ্রাস্তে উপরি উপরি বাজিতে লাগিল। সতীশ তাড়াতাড়ি উঠিয়া বিনয়ের হাত ধরিয়া ঝুলিয়া পড়িয়া মিনতির স্বরে কহিল—“বিনয় বাবু, বসুন, এখনি যাবেন না! আমাদের বাড়ীতে আজ থেয়ে যান! মাসিম, বিনয় বাবুকে থেতে বল না। ললিতা দিদি, কেন বিনয় বাবুকে যেতে বল্লে!” বিনয় কহিল—“ভাই সতীশ, আজ না ভাই! মাসিম যদি মনে রাখেন তবে আর একদিন এসে প্রসাদ খাব। আজ দেরি হয়ে গেছে।” কথাগুলো বিশেষ কিছু নয় কিন্তু কণ্ঠস্বরের মধ্যে অশ্রু আচ্ছন্ন হইয়া ছিল । তাহার করুণা সতীশের মাসিমার কানেও বাজিল । তিনি একবার বিনয়ের ও একবার ললিতার মুথের দিকে চকিতের মত চাহিয়া লইলেন— বুঝিলেন অদৃষ্টের একটা লীলা চলিতেছে। অনতিবিলম্বে কোনো ছুতা করিয়া ললিত উঠিয়া তাহার ঘরে গেল। কত দিন সে নিজেকে নিজে এমন করিয়া কাদাইয়াছে। কাব্যে বঙ্গদেশের বিশেষত্ব। মাটির গুণ এবং জলবায়ুর উপর ফসল নির্ভর করে ; কাজেই ফসলের প্রকৃতি বুঝিতে হইলে জল বায়ু এবং মাটির প্রকৃতি বুঝিয়া লইতে হয়। বঙ্গদেশের যে বিশেষত্বের ফলে ভারতবর্ষের সমুদয় প্রাদেশিক ভাষার সাহিত্যের মধ্যে বঙ্গসাহিত্যের একটা বিশেষত্ব দেখিতে পাই, এ পর্য্যস্ত কোন ইতিহাস বা খণ্ড-সমালোচনায় তাহার আলোচনা ’ হয় নাই। একালের দুইজন প্রধান কবি,—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কাব্য সমালোচনা করিব বলিয়া সংকল্প করিয়াই দেখিলাম, যে “বাংলার ফলের” কথা বলিবার পূৰ্ব্বে, “বাংলার মাটি বাংলার জল” সম্বন্ধে কিছু বলিয়া লওয়া চাই। নহিলে কাব্যের স্বাভাবিক বিকাশ এবং বিশেষত্ব বুঝিতে পারা যায় না । - এ কালের বঙ্গসাহিত্যের নেতা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তের কবিতাসংগ্রহের প্রকাশের সময়ে, ১৮৮৫