পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/২৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(to 8 মাতার সংবাদ দিতে আসিয়াও সে নিরুদ্বেগে গান শুনি । বলিয়াছিলেন, “তারা একবার ধৰ্ম্মভেদ, আচারভেদ, জাতিভেদ ভুলে,—নতজানু হ’য়ে, করযোড়ে ভক্তিবাপগদগদস্বরে, এই হামলা সুজলা ভারতভূমিকে, প্রাণভরে, মা বলে ডাকুক দেথি !” সম্রাট বুঝেন নাই ; আমরাও বুঝি নাই! তাই এই দুর্দশা! . এই নাটকে কবির আর একটি অভিনব সৃষ্টি মেহেরউন্নিসা। স্বপ্নময়ী মেহের, কবির কল্পনায় চির আরাধ্যা কাব্যস্থদেরীর মত, তাহার লাবণ্য-তরঙ্গের অন্তরালে প্রশান্তত লুকাইয়া রাখিয়াছে। কবি মেথু আর্ণল্ডের ভাষায়— . - Such, poets, is your bride, the Muse! Young, Gay, Randiant, adorn'd outside; a hidden ground of thought and of austerily within. প্রতাপসিংহ নাটকে ঘটনার বহুল সমাবেশ ; এবং চরিত্রও অনেকগুলি চিত্রিত। যে কৌশলে এগুলি সুসম্বদ্ধ হইয়৷ জমাট বাধিয়াছে, তাহা অশেষ প্রশংসার জিনিস। লক্ষ্মীর তিরোধানে, যোশীর মরণে, পৃথ্বীর পরিতাপে,—যে আলোক অসীম স্পন্দন ও নিবৃত্তিতে বিস্তার লাভ করিয়াছে, তাহাতেই প্রতাপসিংহ ভাস্বর। সকলি একসূত্রে গাথা পড়িয়াছে বলিয়৷ ঘটনাবাহুলো এবং চিত্ৰাধিক্যে কোন ৷ দোষ ঘটে নাই। দুর্গাদাস নাটকে, দিলির খা, কাশেম্, গুলনেয়ার ও মহামায়া, সযত্নে চিত্রিত। নৈষধকারের অতিমাত্রায় অলঙ্কার-ছড়ছড়ির বর্ণনায় আছে, যে দময়ন্তীকে গড়িয়া, ব্ৰহ্মাঠাকুর যখন হাত ধুইয়াছিলেন, তখন হাতের সেই রংটুকুতে পদ্মের জন্ম হইয়াছিল। আমি শ্ৰীহৰ্ষ হইলে • বলিতাম,—যে কবি যখন মেহের আঁকিয়া তুলিটি ঝাড়িয়াছিলেন, তখন তাহারি ছিটেফোটায় চিত্রপটের উপর রাজিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছিল। রাজিয়ায় মেহেরের ফুল্লতা ও দীপ্তি আছে, কিন্তু বর্ণের গভীরতা নাই। মেহের স্বপ্ন ; কেননা স্বপ্ন, সৌন্দর্য্য ও চিন্তাময়। কিন্তু রাজিয়া যেন গোলাপী নেশার একটু খানি খেয়াল। রাজিয়ার গায়ে প্রজাপতির ং, কণ্ঠে পাপিয়ার স্বর, এবং সৰ্ব্বাঙ্গে হরিণীর চঞ্চলত। কবি এবং বিজ্ঞানবিং গ্রান্ট এলে যদি উহাকে পরীক্ষা করিতেন, তবে একটু পাগলের ছিটুও পাইতেন। মুমূর্যু প্রবাসী । [ ৮ম ভাগ। রাগিণীর ক্রটি সমালোচনা করিতেছে। “ কিন্তু কবির নাটাকৌশলের হিসাবে, রাজিার চিত্রের প্রয়োজন আছে; নহিলে গুলনেয়ারের কবিত্বশূন্ত নিরবচ্ছিন্ন ভোগলালস, ভাল করিয়া বুঝতে পারা যাইত না। গুলনেয়ার সম্বন্ধে অনেকের মনে থটুকা লাগিড়ে পারে। সে ছায়ানাট বুঝিতে না পারুক, বেলা-মোতিয়া চম্পায় শব্দাতীত মুরগরিমা বুঝিতে না পারুক, কিন্তু কোন জড়-প্রাণা মহাপাপিষ্ঠাও কি স্বামীর মুপের উপর জোর করিয়া অপরের প্রতি আসক্তির কথা বলিতে পারে? চরিত্রের অসংযম ও উচ্ছ জ্বলতায় লোক উন্মাদ হয় ; কিন্তু অতিমাত্র লালসার উন্মত্ততায়ও অত বড় বাদসাহের মুখের I উপর অমন কথা বলা স্বাভাবিক কি ? কিন্তু পাতসাহের মুখে শুনিতেছিযে গুলনেয়ার অতিমাত্র মদ্যপান করিয়াছিল। মহামায়ার চরিত্র অতি সুন্দর অঙ্কিত হইয়াছে। সে যখন গুলনেয়ারকে ক্ষমা করিল, তখনে তাহার প্রাণ প্রতিহিংসার আগুন জলিতেছিল। ইহাই স্বাভাবিক। তেজস্বিনী মহামায়া নারী,—দেবী নহেন ; কিন্তু নারী হইলেও তিনি অসাধারণ নারী। যে দপে তিনি শিশুক্রোড়ে, অশ্বপৃষ্ঠে ছুটিয়াছিলেন, স্বয়ং দিলির র্থ তাহা সাক্ষী। রাজস্থানে যাহা সত্য সত্য ঘটিত, তাহার চিত্র “আদর্শ মাত্র” বলা চলে না। দিলির খাঁ নিৰ্ভীক বীরপুরুষ, সত্যবাদী, জিতেন্ত্রি। উদার এবং মহৎ। যোদ্ধার স্নাযুজালে ও মস্তিষ্কচক্রে, এ গুণসমূহের যুগপৎ বিকাশ বিসম্বাদী নহে কিন্তু দিলিলে মাহাত্ম্য, তাহার সকল গুণের অন্তরালস্থিত কবিীে সমধিক উদ্ভাসিত। ঔরংজেব, দিলিরকে কাপুরুষ বলি ব্যঙ্গ করিবার উদ্যোগ করিতেছিলেন; কিন্তু উদার ও নির্ভীর » দিলির তাহাতে টলিলেন না। দিলির খ ব্যঙ্গ বুধিয়াই স্বীকার করিলেন, যে সৈন্তের মহামায়াকে ধরিতে পারিল না; এবং নিজের কথা কবিত্বের ভাষায় বলিলেন :–“দেধূলা, সে এক মহিমাময় দৃশু। আলুলায়িতকেশী নারী ; বুকের উপর ঘুমন্ত শিশু ! নির্মেঘ উষার চেয়ে নিৰ্ম্মল, বীণা ঝঙ্কারের চেয়ে সঙ্গীতময়, ঈশ্বরের নামের চেয়ে পবিত্র,সেই মাতৃমূৰ্ত্তি।” “ঈশ্বরের নামের চেয়ে পবিত্ৰ", কথাটা | - ৯ম সংখ্যা । ] , কাহারে আপত্তি হইতে পারে। কিন্তু বুঝিতে হইবে যে কবিত্বের ভাষায় ব্যঙ্গকারীকে দিলির ঐ কথা বলিয়া রাষ্টয়াছিলেন। তাছার জাহাপন সরলবিশ্বাস বটে ; কিন্তু নিতান্ত সরলবিশ্বাসীর ঈশ্বর, পুতুলের একটু অন্ন উপরে। কাজেক্ট একটা জীবন্ত যথার্থত সেই সংকীর্ণ নাম অপেক্ষা পবিত্র বইকি ? ক’জনের কাছে ঈশ্বরের নাম, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অসীমতায় এবং বিশ্বপ্রীতির অফুরন্ততায় প্রভাসিত হয় ? আর একটি কথা—ধৰ্ম্মট শাস্ত্র নয়, গবেষণা নয়, দর্শনগ্রন্থের মত নয়। জীবনই ধৰ্ম্ম,—মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যে পবিত্রতা এবং মহত্ত্বের প্রত্যক্ষ অভিনয় দেথি উহাই ধৰ্ম্ম । এই জন্তই দিলির খাঁ দুর্গাদাস ও কাশেমকে লক্ষ্য করিয়া বলিয়াছিলেন,—“স্বর্গে যারা দেবতা আছেন শুনি, তারা কি এদের চেয়েও বড় ?” দিলির খাটি সোণা ; এবং খাটি ভিন্ন কখনো মেকি দেখিয়া ভূলিত না। দিলির খাঁ মহৎ, দুর্গাদাস মহৎ, দরিদ্র কাশেম মহৎ ; এখন কথা এই, যে দিলির খা, দুর্গাদাস ও কাশেমের মধ্যে দেবতা কে ? দুর্গাদাস এবং দিলির খাঁ ধৰ্ম্মপ্রাণ, তেজস্বী, উদারপ্রকৃতি, এবং বীর ; কাজেই তাহারা সাধক, দেবতা নহেন। ফিন্তু উচ্চআকাঙ্ক্ষাহীন, স্বার্থের কিছুমাত্র আকাজপৃষ্ঠ কাশেম, নিঃস্ব অথচ পরার্থপর কাশেম, কৰ্ত্তব্যের অবতার, ও করুণার মূৰ্ত্তি। তিনিই দেবতা। দেবতা কদাপি স্বর্গের সিংহাসনে বসিয়া থাকেন না ; তিনি দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিয়া ফেরেন, নর-সেবা করিয়া ফেরেন। প্রতাপসিংহ এবং দুর্গাদাস কিয়ৎপরিমাণে তুলনায় সমালোচিত হইয়াছে। তুলনায় আর একটি কথার উল্লেখ করিব। দুখানি নাটকই এক শ্রেণীর আত্মরক্ষা এবং যুদ্ধ ঘটনা লইয়া লিখিত ; কিন্তু দুর্গাদাসে কৰ্ম্মসমারোহের ব্যস্ততা, ক্ষিপ্রকারিতা এবং কাজেই সংক্ষিপ্ততা অধিক ;– অন্যদিকে প্রতাপসিংহ নাটকে কৰ্ম্মের গতি অপেক্ষাকৃত মন্থর। দুর্গাদাস সদৰ্পে সম্রাটের সভা হইতে বাহির হইলেন, অমনি দিলিরের সসৈন্ত যাত্রা, যশোবস্তের শিশু পুত্র লইয়া কাশেমের পলায়ন, অশ্বপৃষ্ঠে মহামায়ার প্রয়াণ প্রভৃতি দৃষ্ঠের পর দৃষ্ঠে নিয়ত উৎসাহের প্রবাহ ছুটতেছে, কুত্রাপি বিশ্রাম নাই। এই জন্য সম্ভবতঃ দুর্গাদাস নাটক রঙ্গমঞ্চে দর্শকদিগের অধিক তৃপ্তিবিধান করিতে পারে। ইবনে বতুতার ভারত ভ্রমণ। (te (ł কৰ্ম্মের গতি, উৎসাহের প্রবাহ, বিপদের বাত্য প্রতাপসিংহেও আছে, কিন্তু যোদ্ধার রাত্রি দিনই যুদ্ধ করিতেছে না ; শক্তের সমস্ত পুরণে, ইরার স্বৰ্য্যাস্ত দর্শনে, আকবরের মন্ত্রণায়, অনেক অবসর আছে। রণক্ষেত্র এবং মন্ত্রণাগারের বাহিরে একটু কবিতা পড়ার সময়ও আছে। পৃথ্বীরাজের প্রথম চুম্বনের কবিতা লইয়া বড় বড় রাজ মহারাজাও একটু সময় কাটাইতে পারেন। সৈন্তের ছাউনিতেও দৌলৎ প্রেমে মজিতে পারে, এবং মেহের তাহার জীবনের স্বল্প ঘনাইয়া তুলিতে পারে। রাজিয়ার “চামেলিয়া বেলা চম্পায়” যে অর্থ ধরা যায় না, এ কথা বুঝিবার জন্য দুর্গাদাস নাটকে কেহই বসিয়া নাই ; সকলেই আপনার কৰ্ম্মে, আপীসের বাবুর মত যেন নাকে মুখে দুটি গুজিয় ছুটিতেছে। গতির মন্থরতায় প্রতাপসিংহ ভাবুক পাঠকের বেশি প্রিয়, ঘরে বসিয়া ধীরে ধীরে পড়িলে এই গ্রন্থে কবিত্বরসাস্বাদন করিবার সুবিধা অধিক। ইরা, মেহের, দৌলৎ এবং শক্তসিংহের অনেক উক্তি জমাটবাধা গীতিকবিতা ; অনেকবার ফিরিয়া ফিরিয়া পড়িতে ইচ্ছা হয়। রাজিয়াতে ঝঙ্কার আছে, কিন্তু সেটা ধরিয়া লইয়া কেহ গীতি গড়ে নাই ; কমলার গীতিত বড়শির টোপ, এবং যিনি টোপ ফেলিয়াছেন, তিনি স্বামীগ্রাসের ব্যস্ততায় উদভ্ৰান্ত। কৰ্ম্মক্ষেত্রের জীবন্ত ছবির হিসাবে দুর্গাদাস সুরচিত ; এবং এই শ্রেণীর নাটকই, অভিনয়ের পক্ষে বেশী উপযোগী। ঐবিজয়চন্দ্র মজুমদার। ইবনে বতুতার ভারত ভ্রমণ। ( পূৰ্ব্বভাষ। ) - আবদুল্লা অল মহম্মদ লাওয়াতি তানজি ওরফে ইবনে বতুতা ৭০৩ হিজিরার (১৩০৩ খৃষ্টাব্দে) ১৭ই রজব সোমবার দিবসে মরক্কো রাজ্যের তানজির নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাহার পিতার নাম আবদুল্লা। দ্বাবিংশ বৎসর বয়ঃক্রম কালে হজব্রত ও দেশ পর্য্যটন উদ্দেশুে বৃদ্ধ পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন, জীবন সহচর বন্ধুবান্ধবের স্নেহ-মমতা-পাশ ছিন্ন করিয়া, একাকী নিঃসহায় অবস্থার ৭২৫ হিজিরার ২রা রজব বৃহস্পতিবার দয়াময় অনাথ সহায়ের নাম স্মরণ করিতে