পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/৩৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৫৯০ যাহা হউক, প্রসঙ্গতঃ অনেক দূর মাসিয়া পড়িয়াছি ; নিৰ্ব্বাসনের কথা পরে বলিব। এখন রাজনৈতিক অধিকারের কথাষ্ট বলি। অনেক মধ্যপন্থী মনে করেন যে তাহারা ইংরাজকে খুসি করিয়া কিছু রাজনৈতিক অধিকার বখশিস পাইবেন। এইজন্য তাহারা নিজের চরমপন্থী ভাইদের ত্যজ্যভাই করিয়া গঙ্গাস্নান করিয়া মাথা মুড়াইতেও প্রস্তুত। ইংরাজেরাও ইহাতে ভারি খুসি। ভাল, রাজনীতি ত একটা থেলা ; দেখা যাক্ কে জেতে ! কিন্তু একটা বড় মজা দেখা যাইতেছে। ইংলিশম্যান প্রভৃতি ইংরাজ-চরমপন্থীদের মুখপাত্র ভারতীয় মধ্যপন্থীদের উপরও সস্তুষ্ট নন। তাহারা তিনটা শ্রেণীবিভাগ করিয়াছেন—(১) সম্পূর্ণ অধীনতা, (২) ঔপনিবেশিক স্বাধীনতা, (৩) সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ;-অর্থাৎ একেবারে সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত, উপবেশন বা বাকা হইয়া দাড়ান, এবং সম্পূর্ণ সোজা হইয়া ঘাড় উচু করিয়া দাড়ান। ইংলিশম্যানের দলের লোকেরা আমাদের সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত চান ; উপবেশন বা বঁাকা হইয়া দাড়ান চান না,—কি জানি যদি আমাদের হঠাৎ একেবারে খাড়া হইয়া দাড়াইবার ইচ্ছা জাগিয়া উঠে। তাই তাহার কংগ্রেসের লক্ষ্য যে ঔপনিবেশিক স্বরাজ, তাহা পছন্দ করেন না, ওটাকে সম্পূর্ণ স্বরাজের পথের একটা সরাই বা পান্থশালা মনে করেন। যে মলাঁর উপর এক শ্রেণীর মধ্যপন্থীদের এত অগাধ বিশ্বাস ও ভক্তি, তিনি সম্পূর্ণ স্বরাজপ্রয়াসৗদিগকে বলেন “our enemies" এবং মধ্যপন্থীদিগের লক্ষ্যকে বলেন—“crying for the moon," অর্থাৎ বামনের বা পাগলের বা শিশুর চাদের জন্ত ক্ৰন্দন। স্বতরাং দাড়াইতেছে এই যে মলার মত লোকেরও মতে আমাদের দেশের একদল লোক ইংলণ্ডের শক্ৰ, আর একদল পাগল। আমাদের উভয়সঙ্কট—শত্র বা পাগল কোন নামটা পছন্দ করিব, তাহা স্থির করা নিতান্ত সহজ নয়। মলাঁ যে হঠাৎ বক্তৃতার স্রোতে এই সব কথা এক বার বলিয়া ফেলিয়াছেন তাহ নয়, পুনঃ পুন: বলিয়াছেন। এই সেদিনও ভারত-শাসন-প্রণালী-সংস্কার বিষয়ক • বক্তৃতাতেও সেই কথাই প্রকারান্তরে বলিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, তাহার অবশিষ্ট জীবনকাল যদি কুড়িগুণ লম্বা হইত, তাহা হইলেও তিনি ভারতে পালেমেণ্ট প্রবর্তনের কল্পনা করিতে পারিতেন না। র্তাহার বয়স এখন ৭• । বিলাতের লোকের ৯০ বৎসর বঁাচ কিছু বিচিত্র নহে। তাহা হইলে দাড়াইতেছে এই যে তিনি ২০ × ২• = ৪০ • চারি শত বৎসর পরেও ভারতবাসীদিগকে নিজেদের পালেমেণ্টে দেশশাসনের ক্ষমতা দিতে রাজী নন । যাহা হউক, আমরা কাহারও কথায়, অন্যান্ত সভ্যজাতির মত উন্নত, মুণী ও শক্তিশালী হইবার জন্ত আমাদের বৈধ এবং ধৰ্ম্মসঙ্গত চেষ্টা ছাড়িয়া দিতে পারি না। আমরা প্রবাসী । [ wम छां★ा। trol মানুষ, অন্ত মানুষের মত আমাদেরও উচ্চ আকাঙ্ক | আছে। তাহা ঈশ্বরদত্ত। ঈশ্বরের অঙ্গুলি নির্দেশে : আমরা রাজনৈতিক অধিকারলাভ চেষ্টার কণ্টকাৰী | কিন্তু বৈধ ও ধৰ্ম্মসঙ্গত পথে চলিব। এমন কোন প্রকার সাহস, বীরত্ব, বা আত্মোৎসর্গের কাজ নাই, যাহা আমাদের দেশের লোকে করে নাই, বা করিতে পারে না। সুতরা আমাদের নিরাশ হইবার কোন কারণ নাই। তৰে পথটা ভাল করিয়া চিনিয়া লষ্টয়া দৃঢ়পদে তাহতেই চল উচিত, এবং সেই পথ ধৰ্ম্মসঙ্গত হওয়া চাই। ভারতে এখন ক্ষত্রিয়যুদ্ধের স্থান নাই। কিন্তু বৈশ্বযুদ্ধের অর্থাং শিল্প ও বাণিজ্যের প্রতিযোগিতার যথেষ্ট স্থান আছে, এবং 1 জ্ঞানে, চরিত্রে, ধৰ্ম্মে উন্নত হইবার যে প্রতিযোগিতা তাহ কখনও অসাময়িক হইবার নয়। এই উভয় প্রকার প্রতিযোগিতা আমাদের অবলম্বনীয় পন্থা। ভবিষ্যতে দেশ প্রস্তুত হইলে এবং প্রয়োজন হইলে passive resistances arī č34 Both এ সকল ভবিষ্যতের কথা। বর্তমানে মলাঁ সাহেব যে শাসনসংস্কারের প্রস্তাব করিয়াছেন, তাহাতে আমাদের লাভালাভ কি ? তাহার প্রস্তাব কার্য্যে পরিণত হইলে আমাদের কিছু লাভ আছে বৈ কি ? কিন্তু লর্ড সভা শক্ৰতায় উহা কার্য্যে পরিণত না হইতেও পারে। আর । যদি শীঘ্ৰ পালেমেণ্ট ভঙ্গ হইয় পুননিৰ্ব্বাচনে উদারনৈতিক, দের জিত না হয়, তাহা হইলে ত প্রস্তাব পালেমেন্টে উপস্থিতই হইবে না। কিন্তু প্রস্তাব কার্য্যে পরিণত হইলেও খুব বেশী লাভ নাই। কারণ, জাতীয় উন্নতি অবনতি যে সকল রাজবিধির উপর অধিক পরিমাণে নির্ভর | করে, সে সমস্তই বড় লাটের সভায় হয়। সেখানে প্রজাদের প্রতিনিধির সংখ্যায় কম থাকিবেন। সাম্রাজ্যিক বা প্রাদেশিক আয় ব্যয় সম্বন্ধে আমাদের প্রতিনিধিরা কেবল মন্তব্য প্রকাশ করিতে পরিবেন, শিক্ষা, বা স্বাস্থ্যবৃদ্ধি, ইত্যাদির জন্ত আমরা এক পয়সাও রাজকোষের খরচ বাড়াইতে পারিব না। অর্থাৎ সৰ্ব্বস্ব তোমার, চাবিকাঠিট আমার। প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভায় বে-সরকারী সভ্যের সংখ্যা সরকারী সভ্যের সংখ্যার চেয়ে বেশী হইবে বটে, কিন্তু বেসরকারী সভ্য সকলেই প্রজার প্রতিনিধি বা প্রজাদের দ্বারা নিৰ্ব্বাচিত হইবেন না। তন্মধ্যে ইংরাজ থাকিবেন, গবর্ণমেণ্টের মনোনীত লোক থাকিবেন। সুতরাং বে-সরকারী সমুদয় সভাই কোন আইন প্রণয়নের বেলায় যে প্রজাপক্ষে থাকিবেন, এরূপ সম্ভাবন কম। আর তাহা হইলেও, বে-সরকারী সভ্যদের মতে কোন আইন পাশ হইলেও, তাহা ছোট লাট ও বড় লাটের রঙ্গ করিবার ক্ষমতা থাকিবে। প্রস্তাবের মধ্যে আছে যে মিউনিসিপালিটি, ডিী - ১০ম সংখ্যা । ] বোর্ড প্রভৃতিকে অনেক স্বাধীনতা দেওয়া হইবে। তাছা হইলে একটা খুব লাভ বটে। এক একটি গ্রামকে স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিভূমি করিবার প্রস্তাব আছে। তাহা হইলে, আমরা নিস্বার্থ স্বদেশপ্রেমমূলক চেষ্টা দ্বারা গ্রামগুলিকে জাগাইয়া তুলিতে পারিলে, খুব লাভ হইবে বটে। প্রস্তাবের মধ্যে একটা বড় অনিষ্টকর কথা আছে। তাহা শ্রেণী অনুসারে প্রতিনিধি নিৰ্ব্বাচন ; অর্থাৎ জাতি, ধৰ্ম্ম, জীবিকা আদি অনুসাবে নিৰ্ব্বাচন। ইংলণ্ডে স্কটলণ্ডে বা আয়লণ্ডে রোম্যান কাথলিক ও প্রটেষ্টান্ট, শ্রমজীবী ও মূলধনী, চায ও কারিগর, এইরূপ শ্রেণী ভাগ করিয়া পালেমেণ্টে প্রতিনিধি নিৰ্ব্বাচনের কোন বন্দোবস্ত নাই। আমরা যতদূর জানি কোন সভ্য দেশেই এরূপ ব্যবস্থা নাই। অথচ বিলাতে যে ধৰ্ম্মবিদ্বেষ, শ্রেণীগতবিদ্বেষ ও তজ্জন্ত অশাস্তি নাই, তাহা নহে। এরূপ শ্রেণীবিভাগ দ্বারা জাতিগঠনের অন্তরাকে স্থায়ী করা হয়। সুতরাং আমরা ইহার বিরোধী। কিন্তু এখন মুসলমানদিগকে স্বার্থপর লোকে শিখাইয়াছে যে তাহাদের সঙ্গে হিন্দুদের এত রাজনৈতিক পার্থক্য যে স্বতন্ত্র প্রতিনিধি না পাইলে তাহদের চলে না। যাহাই হউক, ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর প্রতিনিধির নিম্বার্থভাবে কাজ করিলেই কিছুদিনের অভিজ্ঞতাতেই বুঝিতে পারিবেন যে সকল ভারতবাসীরই রাষ্ট্রীয় স্বার্থ এক। আর সকল শ্রেণীর লোকই কিছু রাজনৈতিক অধিকার পাইলে শিক্ষিত ভদ্রলোকেরাও অশিক্ষিত সৰ্ব্বজাতীয় গরিবলোকদের সঙ্গে মিশিতে এবং তাছাদের উন্নতিসাধনের জন্ত চেষ্টা করিতে বাধ্য হইবেন। ইহাও কম লাভ নয়। বাঙ্গলাদেশকে আবার অখণ্ড না করিলে প্রস্তাবিতশাসনপ্রণালীতেও আমাদের কোন লাভ হইবে না। এখন স্পষ্ট কথা বলা ভাল। বঙ্গবিহার ছোটনাগপুর উড়িষ্যা ও আসাম এই সকল প্রদেশবাসী হিন্দু বাঙ্গালীই শিক্ষা, রাজনৈতিক যোগ্যতা ও নৈতিক সাহসে অগ্রসর। কিন্তু পশ্চিমবাঙ্গলার ৭টি বিভাগের মধ্যে হিন্দু বাঙ্গালী কেবল ২টির প্রতিনিধিত্ব পাইবেন, পূৰ্ব্ববঙ্গেও হিন্দু বাঙ্গালী মুসলমান বাঙ্গালী অপেক্ষা সংখ্যায় কম। রাজনৈতিক কাজের জন্ত যোগ্যতম যাহারা তাহদের এই দশা হইলে লাভ কোথায় ? ভিন্ন কোন প্রদেশের উপর আমরা প্রভূত্ব করিতে চাই না। গবর্ণমেণ্ট বিহার উড়িষ্যাদিকে পৃথক করিয়া লইতে পারেন, তাহাতে আমাদের আপত্তি নাই। কিন্তু আমরা সব বাঙ্গালী একত্র থাকিয় আমাদের কষ্টাৰ্জ্জিত শিক্ষা ও রাজনৈতিক যোগ্যতার ফলভোগ করিতে চাই। আমরা এরূপ দেশবিভাগের বিরোধী যদ্বারা যোগ্যতমের তাহদের চাষা অধিকার হইতে বঞ্চিত হয়। এইরূপে প্রজার ইচ্ছার ফিদ্ধে প্রদেশবিভাগ করিবার ক্ষমতা যতদিন গবৰ্ণমেন্টের -৫৯১ থাকিবে, ততদিন আমাদের রাজনৈতিক আকারে কোন মূল্য থাকিবে না। তাহার পর, এখন কার্জনের শিক্ষানীতিতে উচ্চশিক্ষা ক্রমেই অল্প হইতে অল্পতর লোকে পাইবে। এই শিক্ষানীতি পরিবর্ধিত না হইলে আমরা দেশের ছোট বড় কাজের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক উপযুক্ত নেতা কোথায় পাইব , দেশের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার না হইলে প্রজাকুল রাজনৈতিক অধিকারের স্বব্যবহার করবে কেমন করিয়া ? সভাদেশ মাত্রেই প্রাথমিক শিক্ষা সকল ছেলেমেয়ে বিনামূল্যে পায়। আমাদের দেশেই উল গতি । তাহার পর, এই যে বিনা বিচারে দেশের সৰ্ব্বজনপূজ্য মহোপকারী লোকদের নিৰ্ব্বাসন, এই ৰে স্বদেশবান্ধবসমিতি প্রভৃতি দেশের উপকারকার্য্যে নিযুক্ত সভাগুলিকে বিন বিচারে বে-আইনী সভা বলিয়া বন্ধ করিয়া দেওয়া, এরূপ অদ্ভূত আইন প্রচলিত থাকিলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কিরূপে সম্ভব, দেশহিতকর কার্য্যই বা কিরূপে সম্ভব, এবং রাজনৈতিক কোনও অধিকারেরই বা মূল্য কি ? - হইতে পারে যে নিৰ্ব্বাসিত ব্যক্তিরা cनांदौ, ठ्हे८ठ পারে যে সভাগুলি বে-আইনী কাৰ্য্য করিতেছিল। কিন্তু প্রমাণ কোথায়? লাট সাহেব ত পরম্পরাক্রমে শেষে বুদ্ধিমান ধাৰ্ম্মিক গুপ্তচর বা গোয়েন্দাদের কথার উপর নির্ভর করিয়াই ভদ্রলোকদের নাম দাগী করেন। ঘোৱ পাপিষ্ঠ নরহস্তার বিচার আছে। আর অশ্বিনীকুমার দত্ত ও কৃষ্ণকুমার মিত্রের ন্তায় দেশহিতব্ৰত, ধাৰ্ম্মিক, পবিত্ৰচেতা, আত্মোৎস্যই লোকদের বিচার নাই ? দেশে কী অস্তবিদ্রোহ হইতেছিল, কী সৰ্ব্বত্রব্যাপী অশাস্তির আগুন জলিতেছিল যে হঠাৎ এরূপ করা দরকার হইল ? আমরাত জানতাম অশ্বিনী বাবু ও কৃষ্ণ বাবু অনেক সাহসী লোকের উন্মাৰ্গগামিতাকে দমনে রাখিতেছিলেন ও রাখিয়াছিলেন। ইহারা স্বদেশী প্রচার ও বিদেশীপণাবর্জন শিক্ষা দিতেছিলেন বটে ; কিন্তু তাহা বে-আইনী কাজ নহে। বিদেশী বণিকদের চীৎকারে তাহাদিগকে সন্তুষ্ট করিবার জন্ত ইংরাজ গবর্ণমেণ্ট স্বদেশীর নেতাদিগকে নিৰ্ব্বাসিত করিয়া- ৷ ছেন, একথা পথে ঘাটে হাটে বাজারে লোকে বলিতেছে বটে ; কিন্তু বিশিষ্ট প্রমাণ না পাইলে এরূপ কথায় বিশ্বাস করা উচিত নয়। স্বতরাং আবার জিজ্ঞাসা করি, তাহাদের অপরাধ কি ? স্বদেশবান্ধবসমিতি প্রভৃতিরও অপরাধ আমরা জানি না। আমরা জানি, তাহারা স্বদেশীর প্রচলন ও বিদেশী পণ্যের বর্জন, দুর্ভিক্ষক্লিষ্টকে সাহায্যদান, সালিসীর দ্বার মোকদ্দমার নিম্পত্তি, তীর্থযাত্রীদের উপর অত্যাচার নিবারণ ও তাহদের কষ্ট দূরীকরণ, প্রভৃতি সৎকাৰ্য্য করিতেছিলেন।