পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/৩৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(#$bo সুচরিতা আবেগে পরিপূর্ণ হৃদয় লইয়া চুপ করিয়া পরেশ বাবুর কাছে বসিয়া রহিল। পরেশ বাবুও স্তব্ধ হইয়া নিজের অন্তঃকরণের মধ্যে নিজেকে গভীরভাবে নিহিত করিয়া বসিয়া রছিলেন । শুচরিতা তাহার শিষ্যা, তাহার কন্যা, তাহার স্বহৃদু। সে তাছার জীবনের এমন কি, তাহার ঈশ্বরোপাসনার সঙ্গে জড়িত হইয়া গিয়াছিল। যে দিন সে নিঃশব্দে আসিয়া তাহার উপাসনার সহিত যোগ দিত—সে দিন তাহার উপাসনা যেন বিশেষ পূর্ণতা লাভ করিত। প্রতি দিন স্বচরিতার জীবনকে মঙ্গলপূর্ণ স্নেহের দ্বারা গড়িতে গড়িতে তিনি নিজের জীবনকেও একটি বিশেষ পরিণত দান করিতেছিলেন। মুচরিতা যেমন ভক্তি যেমন একান্ত নম্রতার সহিত র্তাহার কাছে আসিয়া দাড়াইয়াছিল এমন করিয়া আর কেহ তাহার কাছে আসে নাই ;–ফুল যেমন করিয়া আকাশের দিকে তাকায় সে তেমনি করিয়া তাহার দিকে তাহার সমস্ত প্রকৃতিকে উন্মুখ এবং উদঘাটিত করিয়া দিয়াছিল। এমন একাগ্রভাবে কেহ কাছে আসিলে মানুষের দান করিবার শক্তি আপনি বাড়িয়া যায়–অন্তঃকরণ জলভারনম্র মেঘের মত পরিপূর্ণতার দ্বারা নত হইয় পড়ে। নিজের যাহা কিছু সত্য যাহা কিছু শ্রেষ্ঠ তাহ কোনো অনুকুল চিত্তের নিকট প্রতিদিন দান করিবার সুযোগের মত এমন শুভযোগ মানুষের কাছে আর কিছু হইতেই পারে না ; সেই দুর্লভ সুযোগ স্বচরিত। পরেশকে দিয়াছিল। এজন্য স্বচরিতার সহিত তাহার সম্বন্ধ অত্যন্ত গভীর হইয়াছিল। আজ সেই মুচরিতার সঙ্গে তাহার বাহ সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে ;–ফলকে নিজের জীবনরসে পরিপক করিয়া তুলিয়া তাহাকে নিজের নিকট হইতে মুক্ত করিয়া দিতে হইবে। এজন্য তিনি মনের মধ্যে যে বেদন অনুভব করিতেছিলেন সেই নিগুঢ় বেদনটিকে তিনি অন্তর্যামীর নিকট নিবেদন করিয়া দিতেছিলেন। স্বচরিতার পাথেয় সঞ্চয় হইয়াছে এখন নিজের শক্তিতে প্রশস্ত পথে মুখে দুঃখে আঘাত প্রতিঘাতে নূতন অভিজ্ঞতা লাভের দিকে যে তাহার আহবান আসিয়াছে তাহার আয়োজন কিছু দিন হইতেই পরেশ লক্ষ্য করিতেছিলেন ; তিনি মনে মনে বলিতেছিলেন, বৎসে যাত্রা কর—তোমার চির প্রবাসী । [ ৮ম ভাগ । জীবন যে কেবল আমার বুদ্ধি এবং আমার আলয়ের দ্বারাই আচ্ছন্ন করিয়া রাথিব এমন কখনই হইতে পরিবে নাঈশ্বর আমার নিকট হইতে তোমাকে মুক্ত করিয়া বিচিত্রের ভিতর দিয়া তোমাকে চরম পরিণামে আকর্ষণ করিয়া লইয়া যান—তাহার মধ্যে তোমার জীবন সার্থক হউক! এই বলিয়া আশৈশব স্নেহপালিত স্বচরিতাকে তিনি মনের মধ্যে নিজের দিক হইতে ঈশ্বরের দিকে পবিত্র উৎসর্গ সামগ্রীর মত তুলিয়া ধরিতেছিলেন। পরেশ বরদাসুন্দরীর প্রতি রাগ করেন নাই, নিজের সংসারের প্রতি মনকে কোনো প্রকার বিরোধ অনুভব করিতে প্রশ্রয় দেন নাই ; তিনি জানিতেন সঙ্কীর্ণ উপকূলের মাঝখানে নুতন বর্ষণের জলরাশি হঠাৎ আসিয় পড়িলে অত্যন্ত একটা ক্ষোভের স্মৃষ্টি হয়—তাহার একমাত্র প্রতিকার তাহাকে প্রশস্ত ক্ষেত্রে মুক্ত করিয়া দেওয়া। তিনি জানিতেন অল্প দিনের মধ্যে স্বচরিতাকে আশ্রয় করিয়া এই ছোট পরিবারটির মধ্যে ৰে সকল অপ্রত্যাশিত সমাবেশ ঘটয়াছে তাহা এথানকার বাধা সংস্কারকে পীড়িত করিতেছে, তাহাকে এখানে ধরি। রাখিবার চেষ্টা না করিয়া মুক্তিদান করিলে তবেই স্বভাবের সহিত সামঞ্জস্ত ঘটিয়া সমস্ত শান্ত হইতে পরিবে। ইহা জানিয়া, যাহাতে সহজে সেই শান্তি ও সামঞ্জস্ত ঘটতে পারে নীরবে তাহারই আয়োজন করিতেছিলেন। দুষ্টজনে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে ঘড়িতে এগারোটা বাজিয়া গেল। তখন পরেশবাবু উঠিয় দাড়াই । স্বচরিতার হাত ধরিয়া তাহকে গাড়িবারান্দার ছাদে লইয়া । গেলেন। সন্ধাকাশের বাষ্প কাটিয়া গিয়া তখন নিৰ্ম্মল অন্ধকারের মধ্যে তারাগুলি দীপ্তি পাইতেছিল । সুচরিতাকে পাশে লইয়া পরেশ সেই নিস্তব্ধরাত্রে প্রার্থনা করিলেনসংসারের সমস্ত অসত্য কাটিয়া পরিপূর্ণ সত্য আমাদের জীবনের মাঝখানে নিৰ্ম্মল মূৰ্ত্তিতে উদ্ভাসিত হইয়া উঠুন। 8 R পরদিন প্রাতে হরিমোহিনী ভূমিষ্ঠ হইয়া পরেশকে প্রণাম করিতেই তিনি ব্যস্ত হইয়া সরিয়া গিয়া কহিলেন । “করেন কি ?” হরিমোহিনী অশ্রুনেত্ৰে কহিলেন, “আপনার ঋণ আমি কোনো জন্মে শোধ করতে পারব না। আমার মত এত | ১১শ সংখ্যা । ]


বড় নিরুপাঙ্গের আপনি উপায় করে দিয়েচেন এ আপনি ভিন্ন আর কেউ করতে পারত না। ইচ্ছে করলেও আমার ভাল কেউ করতে পারে না এ আমি দেখেচি–তোমার উপর ভগবানের খুব অনুগ্রহ আছে তাই তুমি আমার মত লোকের উপরেও অনুগ্রহ করতে পেরেচ!” পরেশ বাবু অত্যন্ত সঙ্কুচিত হইয়া উঠিলেন, কহিলেন, "আমি বিশেষ কিছুই করিনি—এ সমস্ত রাধারাণী—“ হরিমোহিনী বাধা দিয়া কহিলেন “জানি জানি–কিন্তু রাধারাণীই যে তোমার-ও যা করে সে যে তোমারি করা। ওর যখন মা গেল, ওর বাপও রইলন তখন ভেবেছিলুম মেয়েটা বড় দুর্ভাগিনী—কিন্তু ওর দুঃখের কপালকে ভগবান যে এমন ধন্য করে তুলবেন তা কেমন করে জানব বল! দেখ, ঘুরে ফিরে শেষে আজ তোমার দেখা যখন পেয়েছি তখন বেশ বুঝতে পেরেছি ভগবান আমাকেও দয়া করেচেন ।” “মাসী, মা এসেচেন তোমাকে নেবার জন্তে” বলিয়া বিনয় আসিয়া উপস্থিত হইল। সুচরিতা উঠিয়া পড়িয়া ব্যস্ত হইয়া কহিল, “কোথায় তিনি ?” বিনয় কহিল নীচে আপনার মার কাছে বসে আছেন।” স্বচরিতা তাড়াতাড়ি নীচে চলিয়া গেল । পরেশবাৰু হরিমোহিনীকে কহিলেন “আমি আপনার বাড়িতে জিনিষপত্র সমস্ত গুছিয়ে দিয়ে আসিগে।" পরেশবাবু চলিয়া গেলে বিস্মিত বিনয় কহিল—“মাসি, তোমার বাড়ির কথা ত জানতুম না।" হরিমোহিনী কহিলেন “আমিও যে জানতুম না বাবা। জানতেন কেবল পরেশবাবু। আমাদের রাধারাণীর বাড়ি।” বিনয় সমস্ত বিবরণ শুনিয়া কহিল, "ভেবেছিলুম পৃথিবীতে বিনয় একজন করে। একটা কোনো কাজে লাগবে। তাও ফসকে গেল। এ পর্য্যন্ত মায়ের ত কিছুই করতে পারিনি, যা করবার সে তিনিই আমার করেন— মাসীরও কিছু করতে পারব না তার কাছ থেকেই আদায় করব। আমার ঐ নেবারই কপাল দেবার নয়।” কিছুক্ষণ পরে ললিতা ও মুচরিতার সঙ্গে আনন্দময়ী আসিয়া উপস্থিত হইলেন । হরিমোহিনী অগ্রসর হইয়। গিয়া কছিলেন–“ভগবান যখন দয়া করেন তখন আর গোরা। (tనను কৃপণতা করেন না-দিদি, তোমাকেও আজ পেলুম।” বলিয়া হাতে ধারয় তাহাকে আনিয়া মাছুরের পরে বসাইলেন । হরিমোহিনী কহিলেন, “দিদি তোমার কথা ছাড়া বিনয়ের মুখে আর কোনো কথা নেই।” আনন্দমঙ্গী হাসিয়া কহিলেন—“ছেলে বেলা থেকেই ওর ঐরোগ, যে কথা ধরে সে কথা শীঘ্ৰ ছাড়ে না। শীঘ্র মাসির পালাও সুরু হবে!” বিনয় কছিল—“তা হবে, সে আমি আগে ধাকৃতেই বলে রাচি। আমার অনেক বয়সের মাসী, নিজে সংগ্ৰহ করেছি, এতদিন যে বঞ্চিত ছিলুম নানা রকম করে সেটা পুষিয়ে নিতে হবে।” আনন্দময়ী ললিতার দিকে চাহিয়া সহাস্তে কছিলেন— “আমাদের বিনয় ওর যা অভাব তা সংগ্রহ করতেও জানে আর সংগ্রহ করে প্রাণ মনে তার আদর করতেও জানে। তোমাদের ও যে কি চোপে দেখেচে সে আমিই জানি— যা কখনো ভাবতে পারত না তারই যেন হঠাৎ সাক্ষাৎ পেয়েছে ! তোমাদের সঙ্গে ওদের জানাশোনা হওয়াতে আমি যে কত খুসি হয়েছি সে আর কিবলৰ মা ! তোমাদের এই ঘরে যে এমন করে বিনয়ের মন বসেছে তাতে ওর ভারি উপকার হয়েছে। সে কথা ও খুব বোঝে আর স্বীকার করতেও ছাড়ে না।” ললিতা একটা কিছু উত্তর করিবার চেষ্টা করিয়াও কথা খুজিয়া পাইল না, তাহার মুখ লাল হইয়া উঠিল। স্বচরিত ললিতার বিপদ দেখিয়া কহিল—“সকল মানুষের ভিতরকার - ভালটি বিনয়বাবু দেখতে পান, এই জন্তই সকল মানুষের যেটুকু ভাল সেইটুকুই ওঁর ভোগে আসে। সে অনেকট ওঁর গুণ।” বিনয় কহিল—“মা, তুমি বিনয়কে যতবড় আলোচনার বিষয় বলে ঠিক করে রেখেচ সংসারে তার ততবড় শেহৰ নেই। একথাটা তোমাকে বোঝাব মনে করি নিতান্ত অহঙ্কারবশতই পারিনে। কিন্তু আর চর না। মা আর নয়, বিনয়ের কথা আজ এই পৰ্য্যন্ত!” এমন সময় সতীশ তাহার অচিরজাত কুকুরশাবকটাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া লাফাইতে লাফাইতে আসিয়া উপস্থিত