পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/৩৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

o ৬৫২ r - পারব না । হারান বাবু, আমাদের যতই অপরাধ থাক তৰু আজকের মত আমাদেৰ মাপ করতে হবে।” হারান চুপ করিয়া গম্ভীর হইয়া বসিয়া রছিলেন। স্বচরিতা যতই তাহাকে বর্জন করিতেছিল স্বচরিতাকে ধরিয়া রাখবার জেদ ততই তাহার বাড়িয়া উঠিতেছিল। র্তাহার ধ্রুব বিশ্বাস ছিল অসামান্ত নৈতিক জোরের দ্বারা তিনি নিশ্চয়ই জিতিবেন। এখনো তিনি যে হাল ছাড়িয়া দিয়াছেন তাহা নহে কিন্তু মাসীর সঙ্গে মুচরিতা অন্ত বাড়িতে গেলে সেখানে তাহার শক্তি প্রতিহত হইতে থাকিবে এই আশঙ্কায় তাহার মন ক্ষুব্ধ ছিল। এই জন্য আজ তাহার ব্ৰহ্মাস্ত্রগুলিকে শান দিয়া আনিয়াছিলেন। কোনোমতে আজ সকালবেলাকার মধ্যেই খুব কড়া রকম করিয়া বোঝাপড়া করিয়া লইতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। আজ সমস্ত সঙ্কোচ তিনি দূর করিয়াই আসিয়াছিলেন–কিন্তু অপর পক্ষেও যে এমন করিয়া সঙ্কোচ দূর করিতে পারে, ললিতা স্বচরিতাও যে হঠাৎ তৃণ হইতে অস্ত্র বাহির করিয়া দাড়াইবে তাহা তিনি কল্পনাও করেন নাই। তিনি জানিতেন, তাহার নৈতিক অগ্নিবাণ যখন তিনি মহাতেজে নিক্ষেপ করিতে থাকিবেন অপর পক্ষের মাথা একেবারে হেঁট হইয়া যাইৰে। ঠিক তেমনটি হইল না—অবসরও চলিয়া গেল। কিন্তু হারান বাবু হার মানিবেন না। তিনি মনে মনে কহিলেন, সত্যের জয় হইবেই অর্থাৎ হারান বাবুর জয় হইবেই। কিন্তু জয় ত শুধু শুধু হয় না। লড়াই করিতে হইবে। হারান বাবুকোমর বাধিয়া রণক্ষেত্রে প্রবেশ করিলেন। স্বচরিতা কহিল—“মাসি, আজ আমি সকলের সঙ্গে একসঙ্গে খাব—তুমি কিছু মনে করলে চলবে না !” হরিমোহিনী চুপ করিয়া রছিলেন। তিনি মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন স্বচরিতা সম্পূর্ণই তাহার হইয়াছে— বিশেষতঃ নিজের সম্পত্তির জোরে স্বাধীন হইয়া সে স্বতন্ত্র ঘর করিতে চলিয়াছে এখন হরিমোহিনীকে আর কোনো সঙ্কোচ করিতে ছুইবে না-ষোলো আনা নিজের মত করিয়া চলিতে পারবেন। তাই, আজ যখন স্বচরিতা গুচিত বিসর্জন করিয়া আবার সকলের সঙ্গে একত্রে অন্ন গ্ৰহণ করিবার প্রস্তাব করিল তখন তাহার ভাল লাগিল না, তিনি চুপ করিয়া রছিলেন। প্রবাসী । ৮ম ভাগ। স্বচরিতা তাহার মনের ভাব বুঝিয়া কহিল—“আমি তোমাকে নিশ্চয় বলছি এ’তে ঠাকুর খুসি হবেন। সেই আমার অন্তর্যামী ঠাকুর আমাকে সকলের সঙ্গে আজ এক সঙ্গে খেতে বলে দিয়েছেন। তার কথা না মানলে তিনি রাগ করবেন। তার রাগকে আমি তোমার রাগের চেয়ে ভয় করি।” যতদিন হরিমোহিনী বরদাসুন্দরীর কাছে অপমানিত হইতেছিলেন ততদিন স্বচরিতা তাহার অপমানের অংশ লইবার জন্য র্তাহাব আচার গ্রহণ করিয়াছিল এবং আজ সেই অপমান হইতে যখন নিস্কৃতির দিন উপস্থিত হইল তখন মুচরিতা যে আচার সম্বন্ধে স্বাধীন হইতে দ্বিধা বোধ করিবে না, হরিমোহিনী তাছা ঠিক বুঝিতে পারেন নাই। হরিমোহিনী স্বচরিতাকে সম্পূর্ণ বুঝিয়া লন নাই, বোঝাওঁ । র্তাহার পক্ষে শক্ত ছিল। হরিমোহিনী সুচরিতাকে স্পষ্ট করিয়া নিষেধ করিলেন না কিন্তু মনে মনে রাগ করিলেন। ভাবিতে লাগিলেনমা গো, মানুষের ইহাতে যে কেমন করিয়া প্রবৃত্তি হীতে পারে তাহ আমি ভাবিয়া পাই না ! ব্রাহ্মণের ঘরে ত জন্ম বটে ! খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিলেন—“একটা কথা বলি বাছ, যা কর তা কর তোমাদের ঐ লেহারাটার হাতে জল থেয়ো না !” o স্বচরিত কহিল-কেন মাসি, ঐ রামদীন বেছারাইণ্ঠ তার নিজের গোরু দুইয়ে তোমাকে দুধ দিয়ে যায় ! হরিমোহিনী দুই চক্ষু বিষ্ফরিত করিয়া কহিলেন, “অবাস্ত্র করলি ! দুধ আর জল এক হল!” সুচরিত হাসিয়া কছিল—“আচ্ছা মাসি, রামদানের ছোয়া জল আজ আমি পাবনা। কিন্তু সতীশকে যদি তুমি বারণ কর তবে সে ঠিক তার উলটো কাজটি করবে।” হরিমোহিনী কছিলেন—“সতীশের কথা আলাদা।” হরিমোহিনী জানিতেন পুরুষমানুষের সম্বন্ধে নির ংযমের ক্রটি মাপ করিতেই হয়। 88 হারান বাবু রণক্ষেত্রে প্রবেশ করিলেন, - আজ প্রায় পনেরো দিন হইয়া o ললিতা ঈমান ു. ১২শ সংখ্যা । ] কানে গিয়াছে এবং অল্পে অল্পে ব্যাপ্ত হইবারও চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু সম্প্রতি দুই দিনের মধ্যেই এই সংবাদ গুৰ্ব্বনা খড়ে আগুন লাগার মত ছড়াইয়া পড়িয়াছে। ব্রাহ্মপরিবারের “ধৰ্ম্মনৈতিক জীবনে”র প্রতি লক্ষ্য করিয়া এই প্রকারের কদাচারকে যে দমন করা কৰ্ত্তব্য হারান বাবু তাহ অনেককেই বুঝাইয়াছেন। এসব কথা বুঝাইতেও বেশি কষ্ট পাইতে হয় না। যখন আমরা "সত্যের অনুরোধে” “কৰ্ত্তব্যের অনুরোধে” পরের স্খলন নষ্টয়া ঘৃণা প্রকাশ ও দগুবিধান করিতে উদ্যত হই তখন সত্যের ও কর্তল্যের অনুরোধ রক্ষা করা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত ক্লেশকর হয় না। এই জন্য ব্রাহ্মসমাজে হারান বাৰু ৰখন "অপ্রিয়” সত্য ঘোষণা ও “কঠোর” কৰ্ত্তব্য সাধন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন তখন এত বড় অপ্রিয়তা ও কঠোরতার ভয়ে তাহার সঙ্গে উৎসাহের সহিত যোগ দিতে অধিকাংশ লোক পরাংমুখ হইল না। ব্রাহ্মসমাজের হিতৈষী লোকেরা গাড়ি পান্ধি ভাড়া করিয়াও পরম্পরের বাড়ি গিয়৷ বলিয়া আসিলেন, আজকাল যখন এমন সকল ঘটনা ঘটিতে আরম্ভ করিয়াছে তখন "ব্রাহ্মসমাজের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন।” এই সঙ্গে, স্বচরিতা যে হিন্দু হইয়াছে, এবং হিন্দুমাঙ্গীর ঘরে আশ্রয় লইয়া যাগযজ্ঞ তপজপ ও o লইয়া দিন যাপন করিতেছে একথাও পল্পবিত উঠিতে লাগিল । অনেক দিন হইতে ললিতার মনে একটা লড়াই চলিতেছিল। সে প্রতিরাত্রে গুইতে যাইবার আগে বলিতেছিল কখনই আমি হার মানিবন। এবং প্রতিদিন ঘুম ভাঙিয়া বিছানায় বসিয়া বলিয়াছে কোনো মতেই আমি হার মানিব না। এই যে বিনয়ের চিন্তা তাহার সমস্ত মনকে অধিকার করিয়া বসিয়াছে—বিনয় নীচের ঘরে বসিয়া কথা কহিতেছে জানিতে পারিলে তাহার হৃৎপিণ্ডের রক্ত উতলা হইয়৷ উঠতেছে, বিনয় দুই দিন তাহদের বাড়িতে না আসিলে অবরুদ্ধ অভিমানে তাহার মন নিপীড়িত হইতেছে, মাঝে বাৰে সতীশুকে নানা উপলক্ষ্যে বিনয়ের বাসায় যাইবার জন্য উৎসাহিত করিতেছে এবং সতীশ ফিরিয়া আসিলে, বিনয় কি করিতেছি বিনয়ের সঙ্গে কি কথা হইল তাহার "W。 y গোরা । করিয়া বিনয়ের সঙ্গে আসিয়াছে। কথাটা দুই এক জনের - ఆdరి আৰোপান্ত সংবাদ সংগ্ৰহ করিবার চেষ্টা করিতেছে টছ ললিতার পক্ষে যতই অনিবাৰ্য্য হইয়া উঠিতেছে ততই পরাভবের মানিতে তাহাকে অধীর করিয়া তুলিতেছে। বিনয় ও গোরার সঙ্গে আলাপ পরিচয়ে বাধা দেন নাই বলিয়া এক একবার পরেশ বাবুর প্রতি তাহার রাগও হইত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে লড়াই করিবে; মরিবে তবু হারিবে না, এই তাহার পণ ছিল। জীবন যে কেমন করিয়া কাটাইবে সে সম্বন্ধে নানা প্রকার কল্পনা তাহার মনের মধ্যে যাতায়াত করিতেছিল। যুরোপের লোকহিতৈষিণী রমণীদের জীবনচরিতে যে সকল কীৰ্ত্তিকাহিনী সে পাঠ করিয়াছিল সেইগুলি তাহার নিজের পক্ষে সাধ্য ও সম্ভবপর বলিয়া মনে হইতে লাগিল। একদিন সে পরেশ বাবুকে গিয়া কহিল, “বাবা, আমি কি কোনো মেয়ে-ইস্কুলে শেখাবার ভার নিতে পারিনে ?” পরেশ বাবু তাহার মেয়ের মুথের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, ক্ষুধাতুর হৃদয়ের বেদনায় তাহার সকরুণ দুইটি চক্ষু যেন কাঙাল হইয়া এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেছে। তিনি স্নিগ্ধস্বরে কহিলেন "কেন পারবে না মা ? কিন্তু তেমন মেয়েইস্কুল কোথায় ?” যে সময়ের কথা হইতেছে তখন মেয়ে-ইস্কুল বেশি ছিল না, সামান্ত পাঠশালা ছিল এবং ভদ্র ঘরের মেয়ের শিক্ষরিত্রীর কাজে তখন অগ্রসর হন নাই। ললিতা ব্যাকুল হইয়৷ কহিল, “ইস্কুল নেই বাবা ?” পরেশ বাবু কছিলেন, “কই, দেখিনে ত!” ললিত কহিল, ”আচ্ছা, বাবা, মেয়ে-ইস্কুল কি একটা করা যায় না ?” । - পরেশ বাবু কহিলেন, “অনেক খরচের কথা, এবং অনেক . লোকের সহায়তা চাই ।” ললিতা জানিত সৎকর্মের সংকল্প জাগাইয়া তোলাই কঠিন কিন্তু তাহ সাধন করিবার পথেও যে এত বাধা তাহা সে পূৰ্ব্বে ভাবে নাই। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয় সে আস্তে আস্তে উঠিয়া চলিয়া গেল। তাহার এই প্রিয়তম কাটির হৃদরের ব্যথা কোনানে পরেশ বাৰু তাহাই বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন। বিনয়ের সম্বন্ধে । হারান বাবু সে দিন যে ইঙ্গিত করিয়া গিয়াছেন তাহাও