পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(b ব্যাকুল হৃদয়ের উপর হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। নদী তাহাকে লোকালয়ের অশাস্ত কৰ্ম্মক্ষেত্র হইতে কোন আনর্দেশু মৃদুরের দিকে আঙ্গুল দেখাইয়া দিল ;–সেখানে নির্জন জলের ধারে গাছগুলি শাখা মিলাইয়া কি ফুল ফুটাইয়াছে—কি ছায়া ফেলিয়াছে!—সেখানে নিৰ্ম্মল নীলাকাশের নীচে দিনগুলি যেন কাহার চোখের উন্মলিত দৃষ্টি এবং রাতগুলি যেন কাহার চোখের আনত পল্লবের লজ্জাজড়িত ছায়া৯ চারিদিক হইতে মাধুর্যের আবর্ত আসিয়া হঠাৎ গোরাকে যে একটা অতলস্পর্শ অনাদি শক্তির আকর্ষণে টানিয়া লইয়া চলিল পূৰ্ব্বে কোনো দিন সে তাহার কোনো পরিচয় জানিত না । ইহা একই কালে বেদনায় এবং আনন্দে তাহার সমস্ত মনকে একপ্রান্ত হইতে আর এক প্রান্তে অভিহত করিতে লাগিল। আজ এই হেমন্তের রাত্রে, নদীর তীরে, নগরের অব্যক্ত কোলাহলে, এবং নক্ষত্রের অপরিস্ফুট আলোকে গোরা বিশ্বব্যাপিনী কোন অবগুষ্ঠিত মায়াবিনীর সম্মুখে আত্মবিস্তৃত হইয় দণ্ডায়মান হইল ; -এই মহারাণীকে -লে এতদিন নতমস্তকে স্বীকার করে নাই বলিয়াই আজ অকস্মাৎ তাহার শাসনের ইন্দ্ৰজাল আপন সহস্রবর্ণের স্বত্রে গোরাকে জলস্থল আকাশের সঙ্গে চারিদিক হইতে বালিয়া ফেলিল। গোরা নিজের সম্বন্ধে নিজেই বিস্থিত হইয়া নদীর জলশূন্ত ঘাটের একটা পইঠায় বসিয়-পড়ল। বারবার সে নিজেকে প্রশ্ন করিতে লাগিল যে, তাহার জীবনে এ কিসের আবির্ভাব, এবং ইহার কি প্রয়োজন ! যে সংকল্পদ্বারা সে আপনার জীবনকে আগাগোড়া বিধিবদ্ধ করিয়া মনে মনে সাজাইয়া লইয়াছিল তাহার মধ্যে ইহার স্থান কোথায় ? ইহা কি তাহার বিরুদ্ধ ? সংগ্রাম করিয়া ইহাকে কি পরাস্ত করিতে হইবে ? এই বলিয়া গোরা মুষ্টি দৃঢ় করিয়া যখনি বদ্ধ করিল অমনি বুদ্ধিতে উজ্জল, নম্রতায় কোমল, কোন দুইটি স্নিগ্ধ চক্ষুর জিজ্ঞাস্ক দৃষ্টি তাহার মনের মধ্যে জাগিয়া উঠিল—কোন অনিন্দ্যশ্বন্দর স্থাত পানির অঙ্গুলিগুলি স্পর্শসৌভাগ্যের অনাস্বাদিত অমৃত তাহার ধানের সম্মুখে তুলিয়া ধরিল ; গোরার সমস্ত শরীরে পুলকের বিদ্যুৎ চকিত হইয়া উঠিল। একাকী, অন্ধকারের মধ্যে এই প্রগাঢ় অনুভূতি তাহার সমস্ত প্রশ্ন সমস্ত দ্বিধাকে একেবারে নিরস্ত করিয়া দিল । প্রবাসী ।


--l. --`

সে তাহার এই নূতন অঙ্কুতিকে সমস্ত দেহ মন দি পুরে দিকে একটা উপভোগ করিতে লাগিল—ইহাকে ছাড়িয়া সে উঠিছে ইচ্ছা করিল না। অনেক রাত্রে যখন গোরা বাড়ি গেল তখন আনন্দমী খাবার যে ঠাণ্ড হয়ে গেছে।” গোরা কহিল, “কি জানি মা, আজ কি মনে হল, অনেকক্ষণ গঙ্গার ঘাটে বসে ছিলুম।” - আনন্দময়ী জিজ্ঞাসা করিলেন “বিনয় সঙ্গে ছিল বুৰি ?” গোরা কহিল "না, আমি একলাই ছিলুম।" আনন্দময়ী মনে মনে কিছু আশ্চর্যা হইলেন। বিন । প্রয়োজনে গোরা যে এত রাত পৰ্য্যন্ত গঙ্গার ঘাটে বসিয়া ভাবিৰে এমন ঘটনা কখনই হয় নি। চুপ করিয়া বসি৷ ভাবা তাহার স্বভাবই নহে। গোরা যখন অন্তমনস্ক হইয়া । থাইতেছিল আনন্দময়ী লক্ষ্য করিয়া দেখিলেন তাহার মুখে যেন একটা কেমনতর উতলা ভাবের উদ্দীপনা। - আনন্দময়ী কিছুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিলেন, "আজ বুঝি বিনয়ের বাড়ি গিয়েছিলে ?” | গোরা কহিল—“না, আজ আমরা দুজনেই পরেশ বাবুর ওখানে গিয়েছিলুম।” শুনিয়া আনন্দময়ী চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন। আবার জিজ্ঞাসা করিলেন—“ওঁদের সকলের সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছে ?” গোরা কহিল—“স্থা হয়েছে।” আনন্দময়ী। ওঁদের মেয়েরা বুঝি সকলের সাক্ষাতেই [ বেরন ? গোরা । হা, ওঁদের কোনো বাধা নেই। অন্ত সময় হইলে এরূপ উত্তরের সঙ্গে সঙ্গে একটা উত্তেজনা প্রকাশ পাইত, আজ তাহার কোনো লক্ষণ না দেখিয়া আনন্দময়ী আবার চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন। পরদিন সকালে উঠিয়া গোরা অন্যদিনের মত অবিলম্বে মুখ ধুইয়া দিনের কাজের জন্য প্রস্তুত হইতে গেল না। সে অন্তমনস্কভাবে তাহার শোবার ঘরের পূর্বদিকের দরজা । খুলিয়া খানিকক্ষণ দাড়াইয়া রহিল। তাহদের গলিট জিজ্ঞাসা করিলেন "এত রাত করলে যে বাবা, তোমার ২যু সংখ্যা । ] সংলগ্ন জমিতে একটা পুরাতন জাম গাছের মাথার উপরে পাংলা একখণ্ডু শাদা কুয়াসা ভাসিতেছিল এবং তাহার পশ্চাতে আসন্ন স্বৰ্য্যোদয়ের অরুণ রেখা ঝাপসা হইয়া দেখা দিতেছিল। গোরা চুপ করিয়া অনেকক্ষণ সেই দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে সেই ক্ষীণ কুয়াসাটুকু মিশিয়া -- গেৰু, উজ্জল রৌদ্র গাছের শাখার ভিতর দিয়া যেন অনেক গুলো ঝকঝকে সঙিনের মত বিধিয়া বাহির হইয়া আসিল এবং দেখিতে দেখিতে কলিকাতার রাস্ত জনতায় ও কোলাহলে পূর্ণ হইয়া উঠিল। এমন সময় হঠাৎ গলির মোড়ে অবিনাশের সঙ্গে আর কয়েকটি ছাত্রকে তাহার বাড়ির দিকে আসিতে দেখিয়া গোরা তাহার এই আবেশের জালকে যেন এক প্রবল টানে ছিন্ন করিয়া ফেলিল। সে নিজের মনকে একটা প্রচণ্ড আঘাত করিয়া বলিল—ন, এসব কিছু নয় ; এ কোনো মতেই চলিবে না।—বলিয়া দ্রুতবেগে শোবার ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। গোরার বাড়িতে তাহার দলবল আসিয়াছে অথচ গোরা তাহার অনেক পূৰ্ব্বেই প্রস্তুত হইয়া নাই এমন ঘটনা ইহার পূৰ্ব্বে আর একদিনও ঘটতে পায় নাই। এই সামান্ত ক্রটিতেই গোরাকে ভারি একটা ধিক্কার লি। সে মনে মনে স্থির করিল আর সে পরেশ বাবুর বাড়ি যাইবে না এবং বিনয়ের সঙ্গেও যাহাতে কিছুদিন দেখা না হইয়া এই সমস্ত আলোচনা বন্ধ থাকে সেইরূপ চেষ্টা করিবে। সে দিন নীচে গিয়া এই পরামর্শ হইল যে গোরা তাহার দলের দুই তিন জনকে সঙ্গে করিয়া পায়ে স্থাটিয়া গ্রাণ্ডট্রাঙ্ক রোড দিয়া ভ্রমণে বাহির হইবে –পথের মধ্যে গৃহস্থবাড়ি আতিথ্য গ্রহণ করিবে, সঙ্গে টাকাকড়ি কিছুই লইবে না। এই অপূৰ্ব্ব সংকল্প মনে লইয়া গোরা হঠাৎ কিছু অতিরিক্ত পরিমাণে উৎসাহিত হইয়া উঠিল। সমস্ত বন্ধন ছেদন করিয়া এইরূপ খোলা রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িবার একটা প্রবল আনন্দ তাহাকে পাইয়া বসিল । ভিতরে ভিতরে তাহার হৃদয় যে একটা জালে জড়াইয়া পড়িয়াছে, এই বাহির হইবার কল্পনাতেই, সেটা যেন ছিন্ন হইয়া গেল বলিয়া - গোরা। বড় রাস্তাৱ পড়িাছে; ே दड़ রাস্তার পূর্ব প্রান্তে একটা ইস্কুল আছে ; সেই ইস্কুলের (tన --~~- --- তাহার মনে হইল। এইসমস্ত ভাবের আবেশ মে মামাত্র এবং কৰ্ম্মই যে সত্য সেই কথাটা খুব জোরের সহিত নিজের মনের মধ্যে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করিয়া লইয়া যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইয়া লইবার জন্ত, ইস্কুল-ছুটির বালকের মত গোর তাহার একতলার বসিবার ঘর ছাড়িয়া প্রায় ছুটিয়া বাহির হইল। সেই সময় কৃষ্ণদয়াল গঙ্গাস্নান সারিয়া ঘটিতে গঙ্গাজল লইয়া নামাবলী গায়ে দিয়া মনে মনে মন্ত্র জপ করিতে করিতে ঘরে চলিয়াছিলেন। • গোরা একেবারে র্তাহার ঘাড়ের উপর গিয়া পড়িল। লজ্জিত হইয়া গোরা তাড়াতাড়ি তাহার পা ছুইয়া প্রণাম করিল। তিনি শশব্যস্ত হইয়া “থাক্ থাকৃ” বলিয়া সসঙ্কোচে চলিয়া গেলেন। পূজায় বসিবার পূৰ্ব্বে গোরার স্পর্শে র্তাহার গঙ্গাস্নানের ফল মাটি হইল। কৃষ্ণদয়াল যে গোরার সংস্পৰ্শই বিশেষ করিয়৷ এড়াইয়া চলিবার চেষ্টা করিতেন গোরা তাহা ঠিক বুঝিত না ; সে মনে করিত তিনি শুচিবায়ুগ্রস্ত বলিয়া সৰ্ব্বপ্রকারে সকলেরই সংস্রব বাচাইয়া চলাই অহরহ তাহার সতর্কতার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ; আনড্রমক-ত তিনি ম্লেচ্ছ বলিয়৷ দূরে পরিহার করিতেন,–মহিম কাজের লোক, মহিমের সঙ্গে তাহার দেখা সাক্ষাতেরই অবকাশ ঘটিত না। সমস্ত পরিবারের মধ্যে কেবল মহিমের কম্ব শশিমুখীকে তিনি কাছে লইয়া তাহাকে সংস্কৃত স্তোত্র মুখস্থ করাইতেন এবং পূজাৰ্চনাবিধিতে দীক্ষিত করিতেন। ^ কৃষ্ণদয়াল গোরাকর্তৃক তাহার পাদস্পর্শে ব্যস্ত হইয় পলায়ন করিলে পর তাহার সঙ্কোচের কারণ সম্বন্ধে গোরার চেতনা হইল এবং সে মনে মনে হাসিল। এইরূপে পিতার সহিত গোরার সমস্ত সম্বন্ধ প্রায় বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছিল এবং মাতার অনাচারকে সে যতই নিন্দ করুক এই আচারদ্রোহিণী মাকেই গোরা তাহার জীবনের সমস্ত ভক্তি সমর্পণ করিয়৷ পূজা করিত। আহারান্তে গোরা একটি ছোট পুটলিতে গোটাকয়েক কাপড় লইয়া সেটা বিলাতী পৰ্য্যটকদের মত পিঠে বাধিয়। মার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল। কহিল—“ম, আমি কিছু দিনের মত বেরব।” আনন্দময়ী কহিলেন “কোথায় যাবে বাবা ?” গোরা কহিল “সেটা আমি ঠিক বলতে পারচি নে?” আনন্দময়ী ~2.