পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/৩৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

"לףט\ আপনার সহজেই অনুমান করিতে পারবেন। আমার মনে হয়, বৈদেশিক সিভিলিয়ান সাহেবদিগকে এইরূপ ‘কটমট’ ভাষা শিক্ষা দেওয়া হইত বলিয়াই তাহারা দেশীয় ভাষা আয়ত্ব করিতে পারিতেন না। এই তো গেল, বৈদেশিকগণের শিক্ষা পুস্তক ; এখন একবার আমাদের দেশীয় বালকগণের শিক্ষাগ্রন্থের ভাষার নমুনা দেখুন। নিয়ে প্রাচীন শিশুবোধক গ্রন্থ হইতে স্বামীর নিকট স্ত্রীর লিখিত একখানি পত্রের আদর্শ উদ্ধৃত করিলাম – “ঐছিক পারত্রিক ভবার্ণব নাবিক শ্রযুক্ত প্ৰাণেশ্বর মধ্যম ভট্টাচাৰ্য্য মহাশয় পদপল্লবাশ্রয় প্রদানেষু— শ্ৰীচরণ সরসী দিবানিশি সাধন প্রয়াসী দাসী শ্ৰীমতী মালতীমঞ্জরী দেবী প্ৰণম্য প্রিয়বর প্রাণেশ্বর নিবেদনঞ্চাদেী মহাশয়ের শ্ৰীপদ সরোরুহ স্মরণমাত্র অত্র শুভম্বিশেষ। পরং মহাশয় ধনাভিলাষে পরদেশে চিরকাল কালযাপন করিতেছেন যেকালে এ দাসীর কালরূপ লগ্নে পাদক্ষেপ করিয়াছেন সেকাল হরণ করিয়া দ্বিতীয় কালের কালপ্রাপ্ত হইয়াছে। অতএব পরকালের কালরূপকে কিছুকাল সাম্বন করা দুই কালের মুখকর বিবেচনা করিবেন। * * * অতএব জাগ্রত নিদ্রিতার হাস্থ সংযোগ সঙ্কলন পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক শ্রীচরণযুগলে স্থানং প্রদানং কুরু নিবেদন মিতি।” বর্তমানকালের স্বামী পত্নীর নিকট হইতে এবপ্লকার পত্র পাইলে যে কি করেন, তাহা বলা যায় না। প্রাচীনকালে অতিরিক্ত পণ্ডিতি দর্শাইবার আশায় ভাষাকে নিতান্ত দুৰ্ব্বোধ্য করিবার প্রথা যেমন প্রচলিত ছিল, সেইরূপ প্রাচীন প্রথা, আচার ব্যবহার প্রভৃতিও 'মধ্বাভাবে -গুড়ং দপ্তাং'এর স্থায় ঠায়ঠারেই মানিত হইত। পূৰ্ব্বোত্ত পত্ৰখাি মীির নাম করিতে হয় না বলিয়া, স্ত্রী তাইকে ‘প্ৰাণেশ্বর মধ্যম ভট্টাচাৰ্য্য' নামে অভিহিত করিয়াছেন, যেন পৃথিবীতে আর কোনো মধ্যম ভট্টাচাৰ্য্য থাকিতে পারে না। - - একাল পর্যন্ত আমরা যতগুলি বাঙ্গল গন্থ পুস্তকের উল্লেখ করলাম, তাহার একখানিতেও দাড়ি, কম প্রভৃতি ছেদ ব্যবহৃত হয় নাই। সহজিয়া সম্প্রদায়ের কোন কোন পুস্তকে দাড়ির স্থলে ; বিসর্গ বা । ডবল দাড় ব্যবহৃত প্রবাসী । হইয়াছে, কোন কোন পুস্তকে কিছুই ব্যবহৃত হয় নাই। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আমল হইতেই বাঙ্গল গ্রন্থে দাড়ি, কম, সেমিকোলেন প্রভৃতি ছেদও পূর্ণ ছেদের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয় । , - ১৮৩৬ খৃষ্টাব্দে বঙ্গসাহিত্যের উন্নতিসাধন অভিপ্রায়ে সরকারী শিক্ষা বিভাগের উদ্যোগে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সভা’ সৰ্ব্বপ্রথম স্থাপিত হয়। ইহার পূৰ্ব্বে সরকার হইতে বঙ্গসাহিত্য প্রচারের উদ্দেশ্যে আর একবার প্রচেষ্টা হইয়াছিল সত্য। বিজ্ঞান গ্রন্থের অনুবাদের নিমিত্ত বিজ্ঞান অনুবাদ সমিতি’ অধ্যাপক উইলসনের সভাপতিত্বে ১৮২৮ অব্দে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। এই সমিতি হইতে "বিজ্ঞান সেবধি নামে একখানি মাসিক পত্র প্রকাশিত হইতে আরম্ভ হয় এবং তাহাতে ভারতীয় ভূগোল, যন্ত্রবিজ্ঞান, আলোকবিজ্ঞান, বায়ুবিজ্ঞান প্রভৃতি নানা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই উভয় সভাই অধিক দিন অস্তিত্ব রক্ষা করিতে পারে নাই। অতঃপর সরকার তুরক্ষ হইতে কলিকাতা, হুগলী, ঢাকা প্রভৃতি নগরে নৰ্ম্মাল স্কুল স্থাপিত হয়। এই স্কুলে বাঙ্গালা ভাষার সাহায্যে বিজ্ঞান, ইতিহাস, ইউক্লিডের জ্যামিতি প্রভৃতি সমস্ত বিষয় শিক্ষা দেওয়া হইত। শ্রীরামপুরের মিশনারী বিদ্যালয়েও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রাদির সাহায্যে ছাত্রগণকে বাঙ্গলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হইত। এই বিদ্যালয়ের পাঠ্য স্বরূপ পদার্থ বিদ্যাসার, উদ্ভিজ্জ বিদ্যা, কিমিয়া-বিদ্যাসার, পদার্থ জ্ঞানী মালা এবং চিকিৎসা সম্বন্ধীয় কতিপয় বিজ্ঞানগ্রন্থ অনুদিত ও প্রচারিত হয়। রসায়নশাস্ত্র সম্বন্ধে কিমিয়া বিদ্যাসার'ই বঙ্গভাষার প্রথম গ্রন্থ ; ইহা মি: যোহন ম্যাক্ সাহেবের Principles of Chemistry Rtwo so on অনুবাদ হইলেও এই সময় হইতেই প্রমাণ হইতে থাকে। যে, যত্ন ও পরিশ্রম করিলে বাঙ্গলা ভাষায় ইয়ুরোপীয় যাবতীয় বিজ্ঞানেরই আলোচনা করা যাইতে পারে। ব্রাহ্ম সভা ও ব্রাহ্মগণ কর্তৃকও বঙ্গভাষা কম গৌরবান্বিত হয় নাই। তত্ত্ববোধিনী সভা ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা বঙ্গসাহিত্যের যথেষ্ট উন্নতি সাধন করিয়াছে। - ১৮৫১ খৃষ্টাব্দে কতিপয় সিভিলিয়ান ও দেশ বিম্বোৎসাহী ব্যক্তির সাহায্যে কলিকাতায় Vernacular Iorary Society c - w [ ৮ম ভাগ। . ১২শ সংখ্যা । ] নামে এক সাহিত্য সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। y রাজেন্দ্রলাল মিত্র মহাশয় কিয়দিবস এই সমিতির সম্পাদক ছিলেন। সমিতির দ্বারা বঙ্গসাহিত্যের প্রভূত উপকার সাধিত হইয়াছিল । ইহার সভ্যগণকে মাসিক চাদ দিতে হইত এবং সম্পাদক মিত্ৰজা মহাশয় মাসিক ৮০ টাকা বেতন প্রাপ্ত হইতেন। সমিতির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল,—ইযুরোপীয় উৎকৃষ্ট গ্রন্থাদির অনুবাদ ও তাহা দেশমধ্যে প্রচার। সমিতি দুই বৎসরে সতের খানি গ্রন্থ প্রকাশিত ও অতি অল্প মূল্যে বিক্রয় করিবার ব্যবস্থা করে। সমিতির একতম সভাপতি মি: প্র্যাটু বঙ্গসাহিত্যের আলোচনায় নিযুক্ত থাকা সময়ে, সাহিত্যের উন্নতির জন্য সবিশেষ যত্ন ও চেষ্ট৷ করিয়াছিলেন। তিনি সমিতির বার্ষিক বিবরণীতে লিখিয়াছিলেন যে, বর্তমান সময়ে বঙ্গদেশে অধিক মূল্যের গ্রন্থ বিক্রীত হইতে পারে না। গল্পের পুস্তক ও অন্যান্ত আমোদজনক পুস্তকই দেশায়গণের অধিকতর প্রিয় ও অধিক পরিমাণে বিক্রয় হয়। কিন্তু অতি সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় এই ভাবের গ্রন্থাদি রচনা করা অতীব দুরূহ। প্র্যাট্ পঞ্চাশ বৎসর পূৰ্ব্বে যাহা বলিয়াছিলেন, বর্তমানকালেও সে অবস্থার বিশেষ ব্যতিক্রম ঘটে নাই। এই সমিতি হইতে স্ত্রী ফেরিওয়ালা পুস্তক বিক্রয়ার্থে পল্লীগ্রামে প্রেরিত হইত। এই সময়ে সংস্কৃত কলেজের পণ্ডিতগণও সাহিত্যের যথেষ্ট উন্নতি করিয়াছিলেন। উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ভিাবেই বঙ্গীয় সাহিত্যের উন্নতি ও পুষ্ট সাধিত হয়। এই সময় পর্য্যন্ত দেশমধ্যে সাময়িক পত্রাদির প্রচলন ছিল না। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ হইতেই ‘সমাচার দর্পণ’, ‘সংবাদ-কৌমুদী’, ‘চন্দ্রকা’ প্রভৃতি সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রাদির প্রচার আরব্ধ হয়। অতঃপর “বিদ্যাসাগরীয় যুগের” আরম্ভ। এই যুগেই বঙ্গসাহিত্য উন্নতির উচ্চতম সোপানে আরোহণের স্বত্রপাত হয়। আমরা শ্ৰীযুত নগেন্দ্রনাথ বস্তু মহাশয়ের সহিত একযোগে বলিতে পারি,–“ভাগীরথী যেমন হিমালয়ের দূর গভীর কন্দর হইতে নির্গত হইয়া ক্রমে স্বকীয় সঙ্কীর্ণভাব পরিত্যাগ করিয়া ক্রমশ: বিশাল-আকার ধারণ করেন এবং বহুজনপদ অতিক্রম করিয়া অবশেষে শতমুখে সাগর চুম্বনে তার্থ হন, বাঙ্গল" সাহিত্য সেইরূপসী ভাবলোতে - -- - - উত্তরবঙ্গ সাহিত্য-সন্মিলন | ○"ふ উৎপন্ন হইয়া ক্রমশঃ প্রাচীন পণ্ডিতবর্গের পাণ্ডিত্যপ্রবাহে এবং তৎপরে মৃত্যুঞ্জয় ও রামমোহন প্রভৃতির প্রতিভায় স্বকীয় সঙ্কীর্ণতা পরিত্যাগ করিয়াছে এবং বহু অবস্থা অতিক্রম করিয়া, বহুবিধ বিষয়ে বিভক্ত হইয়া শেষে বিস্কাসাগর সঙ্গম লাভে কৃতাৰ্থ হইয়াছে ৷ -ভাগীরথীর সাগরসঙ্গমস্থল যেরূপ মহাতীর্থ স্বরূপ, উহা যেমন, সহস্ৰ সহস্ৰ তীর্থ যাত্রীর পবিত্রতাসাধক ও পুণ্য প্ৰবৰ্দ্ধক, বাঙ্গলা গল্পরচনার বিদ্যাসাগর সঙ্গমও সাহিত্যিকগণের পক্ষে তাদৃশ মহাতীর্থ স্বরূপ। যে রচনা এক সময়ে উৎকট, দুৰ্ব্বোধ, বিশৃঙ্খল ও পূৰ্ব্বাপর রস সম্বন্ধবর্জিত ছিল, বিজ্ঞাসাগর সংস্পর্শে তাছা সুললিত, মুখপাঠ্য ও সুসংস্কৃত হইয়া উঠিয়াছে এবং জগৎ সমক্ষে আপনার অনন্ত গুণগৌরব ও মহিমার পরিচয় দিতেছে। বিদ্যাসাগরের রচনায় বাঙ্গল গল্প ললিত মধুর শব্দাবলীর বিকাশ ভূমিতে পরিণত হইয়াছে।” বিদ্যাসাগরীয় যুগেই বঙ্গ গল্পসাহিত্য প্রভূত শক্তিশালী হইয় উঠে। এক দিকে বিদ্যাসাগর মহাশয় যেমন অক্লান্ত পরিশ্রমে নানা ভাষার জ্ঞান আহরণ করিয়া নানা সুললিত পদে ও শব্দে ভাষার পুষ্টি সাধনে রত হন, অপর দিকে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, অক্ষয়কুমার দত্ত, মাইকেল মধুস্তদন দত্ত, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, রামনারায়ণ তর্করত্ন, এবং পরে দীনবন্ধু মিত্র, প্যারীচাৰ মিত্র ওরফে "টেকচাঁদ ঠাকুর”, কালীপ্রসন্ন সিংহ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি মহাত্মারা গল্প সাহিত্যের ইতিহাসে মহা গৌরবান্বিত ও মহিমাম্বিত স্বর্ণ সিংহাসনে উপবিষ্ট হইয়া আছেন। সাহিত্যের ইতিহাসে তাহারা চিরকাল আi্য ও পূজা প্রাপ্ত হইতে থাকিবেন। . মাইকেল মধুসূদন দত্তের সময়ের কিঞ্চিৎ পূৰ্ব্ব কুইতেইসাধারণতঃ উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ হইতেই বঙ্গদেশে সমাজবিপ্লবের স্থায় এক ঘূর্ণবৰ্ত্ত প্রবাহিত হইতে আরম্ভ হয়। বিদেশীয় সভ্যতার আলোক-রশ্মিতে বঙ্গদেশ উদ্ভাসিত ও সঙ্গে সঙ্গে কুরীতি-স্রোত-প্রবাহ প্রবাহিত হইতে থাকে। পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ বিদেশীয় রীতিনীতির অনু. করণে, বিদেশীয় পানাহারে অনুরক্ত হইয় উঠেন। আঁবার সেই সঙ্গে তাহাদের চিত্তে দেশের এই পরাধীন অবস্থাও জাগ্রত’ হইয়া স্বদেশহিতকর তাহাদিগকে আকৃষ্ট কৱিতে লাগিল ।