পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१७ o অবশ্য সে সিদ্ধান্তটি বাহত দেখিতে বেশ সরল সুন্দর, তাহার এই সরলতাতেই চিত্ত সহজে আকৃষ্ট হয় ; আর আকৃষ্ট হয় তাহার মিথ্যা একত্বে ; কেননা তাহাতে যে একত্ব আছে সে একত্ব আমরাই তাহাতে জুড়িয়া দিয়াছি। আসল কথা, ভারতবর্ষে বাস্তবিক সত্য ততটা সরল নহে। কিসে জীবনের মুখ স্বচ্ছন্দতা, ধন, ঐশ্বৰ্য্য, ও কাৰ্য্যক্ষেত্রের পরিসর বৃদ্ধি হয়, তাহারই অমুসন্ধানে যুরোপীয় সমাজ ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতেছে ; ইহাকেই বলে উন্নতি। পক্ষান্তরে প্রাচ্য-সমাজ, বিশেষত হিন্দুসমাজ একেবারেই নিশ্চল। . তাহারা মনে করে, পরিবর্তন তাহাদের পক্ষে অনিষ্টকর ; সমাজে নূতন কিছু প্ৰবৰ্ত্তিত করা শাস্ত্রবিরুদ্ধ। যেরূপ আমাদের সম্মুখে ভবিষ্যতের মৃগতৃষ্ণিকা,—সেইরূপ উহাদের সমক্ষে অতীতের মৃগতৃষ্ণিক প্রসারিত। ক্ষুদ্র গ্রাম্যসমাজও নিশ্চল। এরূপ অদ্ভুত নিশ্চলত একটা অলৌকিক ব্যাপার বলিলেও হয়। আসনটি টলমল করিতেছে, তবু ভারত সেই আসনে দিব্য আরামে বসিয়৷ আছে। একটা উদগ্র তীক্ষার্থ শৈলের উপর হিন্দুকে বসাইয় দেও, তুমি দেখিবে সে তাহাতেই বেশ গুছাইয়া বসিয়াছে, আপনাকে তাহার সহিত বেশ বনি-বনাও করিয়া লইয়াছে ; কিন্তু শৈলটি একটু চাচিয়া-চুলিয়া লইলে যে সুবিধা হইতে পারে এক্স সে একবারও ভাবে না। এরূপ জড়ধৰ্ম্মের দৃষ্টান্ত আর কোথাও নাই। গ্রামের একটি সংকীর্ণ ঘেরের মধ্যে বিভিন্ন মূল-জাতি (race), বিভিন্ন বর্ণ, বিভিন্ন বংশ পরস্পরের সন্মান রক্ষা করিয়া, বেশ শাস্তিতে বাস করিতেছে। বর্ণদিগের মধ্যে, কতকগুলা নিয়ম দুর্ভেদ্য প্রাকারের মত খাড়া হইয়া রহিয়াছে—এই প্রাকার কেহই লঙ্ঘন করিতে সাহস করে না। এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে, একজন ঝাড়,বর্দার হয় ত তৃষ্ণায় মরিবে, তবু সে একটু জল ভিক্ষা করিবার জন্য একজন উচ্চবর্ণের চৌকাঠ মাড়াইবে না – কেননা, তাহ নিষিদ্ধ। এরূপ নিয়মিতভাবের ফাজ, এরূপ অনাগত বিধান, এরূপ অন্ধ শক্তির বশবৰ্ত্তিত, একটা মধুচক্রেও দেখা যায় না। গ্রামের প্রত্যেক লোকই, মধুমক্ষিকার মত, অভ্রান্ত দক্ষতার সহিত, স্বাভাবিক পটুতার সহিত, আপন আপন নির্দিষ্ট কাজ করিয়া যাইতেছে। প্রবাসী । o [ ৮ম ভাগ। ] কিন্তু এই গ্রাম্যজীবনের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে এত ঘেঁসাঘেঁসি, এত ঠেলাঠেলি সত্ত্বেও, প্রাচীরগুলা এতকাল । ভাঙ্গে নাই কেন ?—ভাঙ্গ দূরে থাক, একটুও টলে নাই। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, গ্রামগুলি যেন বহির্জগত হইতে বিচ্ছিন্ন। স্বতন্ত্রশাসিত নগরগুলায়, বাহিরের প্রভাব বড় । একটা পৌঁছিতে পারে না। তাহারা যে বায়ুমণ্ডল আপন । দের চতুর্দিকে রচনা করে, তাহ বিছাৰোহী নহে; কিন্তু | অভ্যন্তরের ব্যাপার অন্তরূপ হইতেও পারে। অবিশ্রা ঘষাবধি, ঠেকাঠেকিতে এই জটিল যন্ত্রটি এক সময়ে বিণু । ড়াইবার কথা। কিন্তু না,—যন্ত্রটি কখনই থামে না, কখনই ; বিগুড়ায় না। ইহার একটা কারণ প্রথমেই মনে হয়—এই গ্রামগুলি চাষাদের নগর। আমার বিশ্বাস,—ঋতুর নিয়মিত পর্য্যায়, ও কৃষকের অবিশ্রাস্ত ও অপরিবর্তনীয় কৰ্ম্মচক্র হইতেই । সৰ্ব্বদেশীয় কৃষকের মনে, বিশেষতঃ ভারতীয় কৃষকের মনে, প্রাকৃতিক নিয়মের যন্ত্রবৎ সুনিশ্চিততা ও অবিচলতা প্রতিভাত হইয়া থাকে। ইহা ছাড়া, একটি স্থানীয় বিশে কারণও পরিলক্ষিত হয়। হিন্দুসমাজের যন্ত্রটি নিখুঁত বলিলেও হয়। ইহাতে ভারকেন্দ্রের সমতা অতীব নিপুণ ভাবে সংরক্ষিত হইয়াছে। এই সমাজতন্ত্রের মধ্যে সকল । বিষয়েরই বিধি নিষেধ পূৰ্ব্ব হইতেই এরূপ স্বনির্দিষ্ট হই । আছে যে, ব্যক্তিবিশেষ স্বাধীনভাবে যে কোন কাজ করিবে,—নুতন কিছু প্রবর্তিত করিবে,—তাহার কোন পথ । নাই। এই সমাজতন্ত্রে, দেবতার কাজও সীমাবদ্ধ,— কতকগুলি নিয়মের দ্বারা পরিচালিত হইয়া থাকে। কি করিতে হইবে, কি করিতে হইবে না—এই বিষয়ের যেরূপ পুঙ্খানুপুঙ্খ শাস্ত্রীয় নিয়ম ও শাসন, তাহাতে সমাজ একটা গুরুভার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইয়াছে সন্দেহ নাই। অমুক স্থলে, অমুক অবস্থায় কি করিতে হইবে, জীবনের মধ্যে একবারও হিন্দুর তাহা জিজ্ঞাসা করিতে হয় না। একবার নেত্র উন্মীলন করিলেই হিন্দু দেখিতে পায়—তাহার সম্মুখে সুচিন্ত্রিত পথ প্রসারিত—স্থানে স্থানে পিলপা, স্থানে স্থানে প্রাচীরের বেড়া। বর্ণগুলা পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্নউহাদের প্রবেশ-দ্বার একেবারে রুদ্ধ। এক বর্ণ অপর বর্ণসম্বন্ধে কিছুই জানে না। বর্ণগুলা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য - ২য় সংখ্যা । ] .--WikitanvirBot (আলাপ) ১৪:১৬, ২৪ মার্চ ২০১৬ (ইউটিসি)---------- - --- কাজ করে, চিন্তা করে। এমনি কড়াক্কড় শাসন, প্রত্যেক ব্যক্তি আপন আপন নির্দিষ্ট স্থান অধিকার করিয়া রহিয়াছে, তাহার বাহিরে একপাও যাইতে পারে না। সামাজিক শাসন, ধৰ্ম্মমন্ত্রর দ্বারা দৃঢ়ীকৃত হইয়াছে। বদ্ধ প্রাচীর, বিবিধ নিষেধ, দুৰ্ল্লঙ্ঘ্য প্রথা, তাহার উপর আবার ধৰ্ম্মের শিলমোহর—এই সমস্ত বন্ধনে, এই সমস্ত গ্রন্থিতে, সমাজ অষ্ট্রেপৃষ্ঠে বদ্ধ-নিষ্পেষিত—অবরুদ্ধ। T ইহাতেও সম্যক ব্যাখ্যা হয় না ; সম্যকরূপে ব্যাখ্যা করিতে হইলে জাতিগত প্রকৃতিকেও ধর্তব্যের মধ্যে আনিতে হয়। এখানকার লোকেরা কোন একটা কাজ হইয়া গেলেই তাহা ললাটলিপি বলিয়া শাস্তচিত্তে গ্রহণ করে, তাহারা পরিবর্তনকে ভয় করে। যাহা কিছু নূতন তাহাই মন্দ, তাহাই পাপ। যেমন কঠোর তপশ্চর্য্যা ও সন্ন্যাসত্ৰত আমাদের রুচিবিরুদ্ধ, সেইরূপ আমাদের ছটফটানি, আমাদের চলিষ্ণুতা, আমাদের সামাজিক কল্পনা, মধুর ভবিষ্যতের প্রতি আমাদের আকুলত, আমাদের পার্থিব মুখের অন্বেষণ, ছুদিনের জন্য পৃথিবীতে আসিয়া মুখস্বচ্ছন্দতার সহিত জীবন যাপন কবিবার আমাদের চেষ্টা—এই সমস্ত হিন্দুর নিকট দুৰ্ব্বোধ্য। বাচিবার আগ্রহে, পৃথিবীকে আমাদের এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের উপযোগী করিয়া তোল,—ইহাই আমাদের চেষ্টা। আমরা প্রকৃতিকে বশীভূত করি, আমরা প্রকৃতিকে আমাদের কাজে খাটাই, প্রকৃতির দ্বারা আমাদের অভাব মোচন করি। কিন্তু হিন্দুর নিকট জীবনটা-জন্মজন্মাস্তরের আবৰ্ত্ত-পরম্পরা ভিন্ন আর কিছুই নহে, ইহা কঠোর, ইহা ভারবহ। ইহা ভবিষ্যতের জন্য এমন কিছুই দেখাইতে পারে না যাহা লোভনীয়, যাহা আশাপ্রদ, সুতরাং এরূপ জীবন না থাকাই ভাল। প্রত্যেক হিন্দু মনে করে,—এই জন্মপরম্পরায় ক্ষণস্থায়ী জীবন-তরঙ্গে নিঃক্ষিপ্ত হইবার জন্যই সে অনন্ত-ধ্যানের দিব নিদ্রা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া আসিয়াছে। মনে করিও না, এই সূক্ষ্ম কল্পনাটি কেবল দার্শনিক পণ্ডিতের মস্তিষ্কের মধ্যেই বদ্ধ। “ভারতের জাতি ও বর্ণ”—এই গ্রন্থের প্রণেতা রিজলী সাহেব আমাকে একদিন কলিকাতায় এইরূপ বলিয়াছিলেন :–“এই চত্তরের ছায়াতলে দেখ এই গরিব বেচারারা শুইয়া আছে; ইহারা তত্ত্বজ্ঞানী পণ্ডিত সমসাময়িক ভারত। . ११ - SAMASAMMSMMSMMSMMSMSMMMMS নহে ; বাস্তবিকই ইহাদের জীবনে বিতৃষ্ণা হইয়াছে, জীবনকে ইহারা কষ্টকর বলিয়া মনে করে, এবং কি করিয়া এই দুঃখময় সংসার হইতে কিছুকালের জন্য নিস্কৃতি পাইবে ইহার এই স্বপ্লই দেখে এবং এই স্বপ্ন দেখিতে দেখিতেই একেবারে অচেতন হইয়া পড়ে।” এ দেশে “যোগী” নামে অদ্ভুত এক দল লোক আছে ; এই ভাবটি,—এই আদর্শটি, তাহাদের মধ্যেই যেন মূৰ্ত্তিপরিগ্রহ করিয়াছে। এই "ক্লরোফম্”-মুগু হতচেতন সমাজ যদি বা কখন জাগরণোন্মুখ হয়, উহার শিয়রে যে দুই প্রহরী বসিয়া আছে রমণী ও পুরোহিত, তাহারা আবার তাড়াতাড়ি উহার নেত্র নিমীলিত করিয়া দেয়। সমাজের যে কোন সংস্কার হউক না কেন, উহারা তাহার পরিপন্থী। অবশ্য ব্রাহ্মণের প্রতিকূলতা স্বাভাবিক । ব্রাহ্মণের যেরূপ অবস্থা, তাহাতে সমাজের একটা সামান্ত পরিবর্তন হইলেও, তাহার নিজস্ব অধিকারের উপর আঘাত লাগে। স্ত্রীলোকদের প্রতিকূলতার তেমন কিছু হেতু দেখা যায় না। যে সামাজিক অবস্থা স্ত্রীলোকের পক্ষে অতীব কষ্টকর ও যন্ত্রণাদায়ী তাহার সেই অবস্থায় যদি কিছু পরিবর্তন সঙ্ঘটিত হয় সে ত আশারই কথা, তাহাতে আশঙ্কার বিষয় কি আছে ? কিন্তু এই বন্দিনী তাহার শৃঙ্খলকেই আগ্রহের সহিত চুম্বন করে, এই নিৰ্য্যাতিত নারী স্বকীয় কষ্ট যন্ত্রণ স্বেচ্ছাপূৰ্ব্বক সহ করিয়া থাকে। যখন ১৮২৯ খৃষ্টাব্দে সহমরণের বিরুদ্ধে আইন প্রচারিত হয়, তখন রমণীরা ইহার প্রতিবাদ করে। যখন অল্পবয়স্ক বালিকার বিবাহের বিরুদ্ধে, বালিকার চিরবৈধব্যের বিরুদ্ধে, আন্দোলন চলিতেছিল, তখন সৰ্ব্বাগ্রে প্রতিবাদ করে কে ?— রমণীরাই । যখন পবিত্র গঙ্গাতীরে সতীত্বের জন্ত স্ত্রীলোকেরা অনায়াসে আত্মহত্যা করিত—তখন তাহারা যে চিরবৈধব্যের পক্ষপাতী হইবে তাহাতে আশ্চৰ্য্য কি ? এই ভীষণ ব্রতটি মানব-হৃদয় হইতেই প্রস্থত। সহমরণ, সন্ন্যাসব্রত, কঠোর বৈধব্যব্রত—এই সমস্ত উচ্চবর্ণেরই বিশেষ-অধিকার,—উহার দ্বারা উচ্চবর্ণের বিশিষ্টতা রক্ষিত হয়। Saobism সমাজের উৎকৃষ্ট পুলিস প্রহরী নহে কি ? যে রমণী কঠোর সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে সে একটা উচ্চতর জগতে প্রবেশ করে না কি ? সেকালে মৃত স্বামীর চিতায় দ্বন্ধ হওয়া একটা শিষ্টচারের মধ্যে পরিগণিত হইত। -