পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

»२० ধৰ্ম্মতত্ত্ব সম্বন্ধে ইংরেজি বই পড়িয়া তাহারই নির্দেশ মত চলিতে থাকিবে এইরূপ সঙ্কল্প করিল। তাহার পক্ষে যাহা দুরূহ, এমন কি, অপ্রিয়, তাহাই গ্রহণ করিবার প্রতিজ্ঞ করিয়া সে মনের মধ্যে খুব একটা স্ফীতি অনুভব করিল। যাহা নীরস যাহা দুষ্কর আমার পক্ষে তাহার বিশেষ প্রয়োজন হইয়াছে ; নতুবা শৈথিল্যের আকর্ষণে আমি যে কোথায় ভাসিয়া যাইতেছি এবং তাছার পরিণামফল যে কি তাহার কোনো ঠিকানা নাই--এই বলিয়া সে মনে মনে কোমর বাধিয়া দাড়াইল । হারানবাবুর সম্পাদিত ইংরেজি কাগজ কিছুকাল ধরিয়া । সে পড়ে নাই। আজ সেই কাগজ ছাপা হইবামাত্র তাহার হাতে আসিয়া পড়িল। বোধ করি হারানবাব বিশেষ করিয়াই পাঠাইয়া দিয়াছেন। সুচরিতা কাগজখানি ঘরে লইয়া গিয়া স্থির হইয়া বসিয়া পরম কৰ্ত্তব্যের মত তাহার প্রথম লাইন হইতে পড়িতে আরম্ভ করিল। শ্রদ্ধাপূর্ণ চিত্তে নিজেকে ছাত্রীর মত জ্ঞান করিয়া এই পত্রিকা হইতে উপদেশ গ্ৰহণ করিতে লাগিল । জাহাজ পালে চলিতে চলিতে হঠাৎ পাহাড়ে ঠেকিয়া কাৎ হইয়া পড়িল। এই সংখ্যায় “সেকেলে বায়ুগ্রস্ত” নামক একটি প্রবন্ধ আছে, তাহাতে, বর্তমান কালের মধ্যে বাস করিয়াও যাহারা সেকালের দিকে মুখ ফিরাইয়া আছে, তাহাদিগকে আক্রমণ করা হইয়াছে। যুক্তিগুলি যে অসঙ্গত তাহা নহে, বস্তুত এরূপ যুক্তি স্বচরিতা সন্ধান করিতেছিল কিন্তু প্রবন্ধটি পড়িবামাত্রই সে বুঝিতে পারিল যে এই আক্রমণের লক্ষ্য গোরা। অথচ তাহার নাম নাই, অথবা তাহার লিখিত কোনো প্রবন্ধের উল্লেথ নাই। প্রত্যেক গুলিতে একটা করিয়া মানুষ মারিয়া সৈনিক যেমন খুঁসি হয় এই প্রবন্ধের প্রত্যেক বাক্যে তেমনি কোনো একটি সজীব পদার্থ বিদ্ধ হইতেছে বলিয়া যেন একটা হিংসার আনন্দ ব্যক্ত হইয়া উঠিয়াছে। এই প্রবন্ধ স্বচরিতার পক্ষে অসহ্য হইয়া উঠিল। ইহার প্রত্যেক যুক্তি প্রতিবাদের দ্বারা গণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিতে তাহার ইচ্ছা হইল। সে মনে মনে কহিল গৌরমোহন বাবু যদি ইচ্ছা করেন তবে এই প্রবন্ধকে তিনি ধূলায় লুটাইয়া দিতে পারেন। গোরার উজ্জ্বল মুথ তাহার প্রবাসী । ৮ম ভাগ। | ৩য় সংখ্যা । ] BBB BB BBB BBB BB BBB BB S BB BBB BBB BBB BBBB BBBB BBB প্রবল কণ্ঠস্বর স্বচরিতার বুকের ভিতর পর্যন্ত ধ্বনি / রিয়া দিয়াছে—এমন কি, সে যে আপনাকে সমর্পণ দিল । অনেক কাল পরে সুচরিতা আপনি সে দিন বিনয়ের নিজের সম্বন্ধ লইয়া কাছে আসিয়া বসিল এবং তাহাকে কথায় কথায় বলিল “আচ্ছা, আপনি যে বলেছিলেন যে সব কাগজে আপনা? লেপ বেরিয়েছে আমাকে পড়তে এনে দেবেন, কই দিলে না ?” ভাবান্তর দেপিয়া সে আপন প্রতিশ্রুতি পালন করিতে সাহল করে নাই-সে কহিল, “আমি সেগুলো একত্রে সংগ্ৰহ করে রেখেছি, কালই এনে দেব।” বিনয় পর দিন পুস্তিকা ও কাগজের এক পুটনি। আনিয়া মুচরিতাকে দিয়া গেল। মুচরিতা সেগুলি হাতে পাইয়া আর পড়িল না বাক্সের মধ্যে রাখিয়া দিল। পড়িতে অত্যন্ত ইচ্ছা করিল বলিয়াই পড়িল না। মতেই বিক্ষিপ্ত হইতে দিবে না প্রতিজ্ঞা করিয়া নিজের বিদ্রোহী চিত্তকে পুনৰ্ব্বার হারানবাবুর শাসনাধীনে সমর্পণ করিয়া আর একবার সে সান্তন অনুভব করিল। 2৬ বিনয় কয়দিন গোরার কথা ভাবিলার অবকাশ মাত্র পায় নাই। একদা, মানুষের মধ্যে গোরাই বিনয়ের চিন্ত করিবার প্রধান বিল ছিল। ইতিপূৰ্বে গোৱাৰ গতি । বিনয়ের এতদিনের বিচ্ছেদ কখনই ঘটে নাই ; ঘটিলেও বিনয় অনায়াসে তাহ বহন করিতে পারিত না । এবারে গোরার অনুপস্থিতি বিনয় যে কেবল অনুভব করে নাই তাহা নহে, এই অনুপস্থিতিকালে সে বিশেষ করিয়া একটা স্বাতন্ত্র্যস্তুপ উপভোগ করিয়াছিল। গোরা' কোন কাজটাকে কিরূপ ভাবে দেখিবে বিনয় এপর্যন্ত জ্ঞাতসারে এবং অজ্ঞাতসারেও তাছাই বিচার করিয়া কাজ করিয়াছে। লিনয়ের সঙ্গে গোরার প্রকৃতিভেদ থাকা সত্ত্বেও আজ পর্য্যন্ত ইহাতে কোনো বিঘ্ন ঘটে নাই। গোরার o বিনয় এ কথা বলিল না যে ইতিমধ্যে সুচরিতা। চিত্তকে কোনো। হইয়া উঠিল। সেই মুখের ও বাক্যের অসামান্ততা দিছে সে কথাও সে আপনি জানিত না। কাছে এই প্রবন্ধ ও প্রবন্ধলেপকের ক্ষুদ্রতা এমনই ভূক্ষ্ম । হইয়া উঠিল যে স্বচরিত কাগজ থানাকে মাটিতে ফেলিয়। বিনকে গোরার অনুবর্তী বলিয়া ললিত যখন তাহাকে দুই একটা খোচা দিয়াছিল তখন বিনয় সেটাকে নিতান্ত মল্লায় মনে করিয়াছিল। কিন্তু তখনই গোরার সহিত বিনয় সচেতন হইয়া উঠিয়াছিল। গোরার আধিপত্য অস্বীকার করিতে গিয়াই গোরার আধিদ্য সে অনুভব করিয়াছিল । সে মাঝে মাঝে বুঝিতে গরিয়াছিল যে, গোরার ভাবনার দ্বারা নিজের ভাবনাকে ধিয়া লইবার জন্য তাহার মন কথন যে অভ্যস্ত হইয়া গিাছে তাহা সে নিজেই বুঝিতে পারে নাই। গোরার এই আধিপত্যে এতদিন পরে বিনয় পীড়া ও লজ্জা অমুভব করিয়াছে। এমন কি গোরার সঙ্গে কোনো কোনো বিষয়ে জাহার মত যে মেলে না এই কথা বলিবার জন্য তাহার মন | বাগ্র হইয়া উঠিয়াছে। অথচ সে কথা বলিতে তাহার য়ে কষ্টবোধ হইতে লাগিল। গোরা যে এতদিন তাহার শৃ আয়ুগত্য পাইয়াছে সেই আনুগত্য হইতে তাহাকে সহসা আজ বঞ্চিত করিলে গোরা যে কত বড় একটা আঘাত | পাইবে তাহা মনে করিলেও বিনয় বেদন বোধ করে। এবারে কয়দিন গোর উপস্থিত না থাকাতে বিনয় অত্যন্ত অবাধে পরেশ বাবুর পরিবারের সঙ্গে সকল রকম করিয়া মিশিয়া যাইতে পারিয়াছিল। বিনয়ের স্বভাব এইরূপ অবারিতভাবে প্রকাশ পাওয়াতে পরেশ বাবুর বাড়ির সকলেই একটা বিশেষ তৃপ্তি অনুভব করিল। নিও নিজের এইরূপ বাধামুক্ত স্বাভাবিক অবস্থা লাভ, করিয়া যেরূপ আনন্দ পাইল এমন আর কখনো পায় | নাই। তাহাকে যে ইহঁাদের সকলেরই ভাল লাগিতেছে ইহাই অনুভব করিয়া তাহার ভাল লাগাইবার শক্তি আরো বাড়িয়া উঠিল। তাহার মুখে চক্ষে হাসিতে কথায় প্রফুল্লতা সৰ্ব্বদা বিকীর্ণ হইতে থাকিল। পরিবারের বন্ধুবৰ্গ যে কেহ বিনয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়াছে সকলেই তাহার বুদ্ধির অজস্র প্রশংসা করিল। বাস্তবিক নি নিজের বুদ্ধিকেও নিজে জানিত না –সে সৰ্ব্বদ গোরার অসামান্তত অনুভব করিয়া নিজেকে সম্পূর্ণ ব্যক্ত R - গোরা । >ミン করিবার উদ্যম প্রয়োগ করিত না। এখন চারিদিকের একটা উৎসাহের উত্তেজনায় সে নিজের বুদ্ধির স্ফূৰ্ত্তি নিজেই বোধ করিতে পারিয়াছিল। তাহার প্রকৃতির মধ্যে একটা পরিপূর্ণতার জোয়ার আসিয়া তাহার বুকের ভিতরে দিন রাত্রি একটা কলধ্বনি চলিতে লাগিল। অভিনয়ের সহায়তা করা, আবৃত্তি করা, আবৃত্তি শেখানে, কাগজ লেখl, সভায় বক্তৃতা দেওয়া প্রভৃতি নানাদিকেই তাহার আনন্দিত শক্তি যেন ছুটয় চলিল। এতদিন পরে সে স্পষ্ট বুঝিতে পারিল যে, সে লোককে খুসি করিতে পারে, এমন কি, শিক্ষা দিতেও পারে। গোরার কথা বিনয়ের মনে আর তেমন করিয়া জাগিল না । বাসায় ফিরিতে তাহার রাত হইত ; ফিরিয়া আসিয়া একলা ঘরে অনেকক্ষণ চুপ করিয়া অস্তরের উত্তেজনাকে পরিপাক করিত। সেই অবকাশের সময়, গোর কোথায় আছে, কি করিতেছে, এ চিন্তা তাহার মনে যদি ক্ষণকালের জষ্ঠ জাগিত তবে পরক্ষণেই পরেশ বাবুর বাড়িতে দিনযাপনের বহুবিধ স্মৃতিতে তাহা একেবারেই আচ্ছন্ন হইয়া যাইপ্ত। প্রাতঃকালে ঘুম হইতে উঠিয়াই, আজ বিকালে তিনটার সময় পরেশ বাবুর বাড়িতে যাইতে হইবে, এই কথাটাই সৰ্ব্বপ্রথমে মনে পড়িত ;–এই চিস্তায় তাহার প্রথম প্রভাতের স্বৰ্য্যালোক সমুজ্জল হইয়া উঠিত। ইতিমধ্যে কোনো কোনো দিন আনন্দময়ীর ওখানে একবার ছুটিয়া যাইত—আবার কোনোদিন বা সতীশকে তাহার বাসায় নিমন্ত্ৰণ করিয়া আনিয়া তাহার সমবয়সীর মত তাহার সঙ্গে আনন্দ করিয়া মধ্যাহ্ন কাটাইয়া দিত। প্রকৃতির এই প্রসারণের সময়ে, নিজেকে স্বতন্ত্র শক্তিতে অনুভব করিবার দিনে বিনয়ের কাছ হইতে স্বচরিতা দূরে চলিয়া গেল। এই ক্ষতি এই আঘাত অন্ত সময় হইলে দুঃসহ হইত, কিন্তু এখন সেটা সে সহজেই উত্তীর্ণ হইয়৷ গেল। আশ্চৰ্য্য এই যে, ললিতাও মুচরিতার ভাবান্তর উপলক্ষ্য করিয়া তাহার প্রতি পূৰ্ব্বের স্যার অভিমান প্রকাশ করে নাই। আবৃত্তি ও অভিনয়ের উৎসাহই "কি তাহাকে সম্পূর্ণ অধিকার করিয়াছিল ? 3" রবিবার দিন সকালে আনন্দময়ী পান সাজিতেছিলেন,