পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

>२२ শশিমুখী তাহার পাশে বসিয়া স্বপারি কাটিয়া স্ত,পাকার করিতেছিল। এমন সময় বিনয় আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিতেই শশিমুখী তাহার কোলের আঁচল হইতে সুপারি ফেলিয়া দিয়া তাড়াতাড়ি ঘর ছাড়িয়া পলাইয়া গেল। আনন্দময়ী একটুখানি মুচকিয়া হাসিলেন। বিনয় সকলেরই সঙ্গে ভাব করিয়া লইতে পারিত। শশিমুখীর সঙ্গে এতদিন তাহার যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। উভয় পক্ষেই পরম্পরের প্রতি খুব উপদ্রব চলিত। শশিমুখী বিনয়ের জুতা লুকাইয়া রাখিয় তাহার নিকট হইতে গল্প আদায় করিবার উপায় বাহির করিয়াছিল। বিনয় শশিমুখীর জীবনের দুই একটা সামান্ত ঘটনা অবলম্বন করিয়া তাহাতে যথেষ্ট রংফলাইয়া দুই একটা গল্প বানাইয়া রাখিয়াছিল তাহারই অবতারণা করিলে শশিমুখী বড়ই জব্দ হইত—প্রথমে সে বক্তার প্রতি মিথ্যাভাষণের অপবাদ দিয়৷ উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদের চেষ্টা করিত ; তাহাতে হার মানিলে ঘর ছাড়িয়া পলায়ন করিত। সেও বিনয়ের জীবনচরিত বিকৃত করিয়া পাণ্টা গল্প বানাইবার চেষ্টা করিয়াছে—কিন্তু রচনাশক্তিতে সে বিনয়ের সমকক্ষ না হওয়াতে এসম্বন্ধে বড় একটা সফলতা লাভ করিতে পারে নাই! যাহা হোক, বিনয় এ বাড়িতে আসিলেই সব কাজ ফেলিয়া শশিমুখী তাহার সঙ্গে গোলমাল করিবার জন্য ছুটিয়া আসিত। এক একদিন এত উৎপাত করিত যে আনন্দময়ী তাহাকে ভৎসনা করিতেন কিন্তু দোষ ত তাহার একলার ছিল না, বিনয় তাহাকে এমনি উত্তেজিত করিয়া তুলিত যে আত্মসম্বরণ করা তাহার পক্ষে অসম্ভব হইত। সেই শশিমুখী আজ যখন বিনয়কে দেখিয়া তাড়াতাড়ি ঘর ছাড়িয়া পলাইয় গেল তখন আনন্দময়ী হাসিলেন কিন্তু সে হাসি মুখের হাসি নহে। বিনয়কেও এই ক্ষুদ্র ঘটনায় এমন আঘাত করিল যে সে কিছুক্ষণের জন্ত চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বিনয়ের পক্ষে শশিমুর্থীকে বিবাহ করা যে কতখানি অসঙ্গত তাহ এইরূপ ছোটখাটাে ব্যাপারেই ফুট উঠে। বিনয় যখন সন্মতি দিয়াছিল তখন সে কেবল গোরার সঙ্গে তাহার বন্ধুত্বের কথাই চিন্তা করিয়াছিল, ব্যাপারটাকে কল্পনার দ্বারা অনুভুব করে নাই। তা ছাড়া, আমাদের দেশে প্রবাসী । - [ ৮ম ভাগ। বিবাহটা যে প্রধানত ব্যক্তিগত নহে তাহ পারিবাদি। এই কথা লইয়া বিনয় গৌরব করিয়া কাগজে অনেক গ্রন লিথিয়াছে ; নিজেও এ সম্বন্ধে কোনো ব্যক্তিগত ইচ্ছা। বিতৃষ্ণাকে মনে স্থানও দেয় নাই। আজ শশিমুণী । বিনয়কে দেখিয়া আপনার বর বলিয়৷ জিভ কাটিয়া পলাষ্ট্র গেল ইহাতে শশিমুর্থীর সঙ্গে তাহার ভাবী সম্বন্ধের এক্ট চেহারা তাহার কাছে দেখা দিল। মুহুর্তের মধ্যেই তাম্বা। সমস্ত অন্তঃকরণ বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। গোরা যে তারা প্রকৃতির বিরুদ্ধে তাহাকে কতদূর পর্যন্ত লইয়া যাইতেছি। ইহা মনে করিয়া গোরার উপরে তাহার রাগ হইল, নিজে উপরে ধিক্কার জন্মিল, এবং আনন্দময়ী যে প্রথম হইয়ে এই বিবাহে নিষেধ প্রকাশ করিয়াছেন তাহা স্মরণ কলি তাহার স্বাক্ষদর্শিতায় তাহার প্রতি বিনয়ের মন বিশ্নয়মিঞ্জি ভক্তিতে পূর্ণ হইয়া উঠিল। আনন্দময়ী বিনয়ের মনের ভাবটা বুঝিলেন। তি;ি অন্যদিকে তাহার মনকে ফিরাইবার জন্ত বললেন, " গোরার চিঠি পেয়েছি, বিনয় ।” বিনয় একটু অন্তমনস্ক ভাবেই কহিল “কি লিখেচে ।" | আনন্দময়ী কহিলেন, “নিজের খবর বড় একটা কি দেয়নি। দেশের ছোট লোকদের দুর্দশা দেখে দুঃখ কা লিখেছে। ঘোষপাড়া বলে কোন এক গ্রামে ম্যাজিষ্ট্রে কি সব অন্যায় করেচে তারই বর্ণনা করেচে।" গোরার প্রতি একটা বিরুদ্ধ ভাবের উত্তেজনা হইতেই অসহিষ্ণু হইয়া বিনয় বলিয়া উঠিল-—“গোরার ঐ পরে। দিকেই দৃষ্টি, আর আমরা সমাজের বুকের উপরে বলে প্রতিদিন যে সব অত্যাচার করচি তা কেবলই মার্জন করতে হবে, আর বলতে হবে এমন সংকৰ্ম্ম আর কিছু হতে পারে না !” হঠাৎ গোরার উপরে এই দোষারোপ করিয়া বিনা যেন অন্ত পক্ষ বলিয়া নিজেকে দাড় করাইল দেখি৷ আনন্দময়ী হাসিলেন। - বিনয় কহিল, “মা, তুমি হাসচ, মনে করচ হঠাৎ বিন এমন রাগ করে উঠল কেন ? কেন রাগ হয় তোমাকে বলি। সুধীর সেদিন আমাকে তাদের নৈহাটি ষ্টেশনে তার এক বন্ধুর বাগানে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা শেয়া ৩য় সংখ্যা । ] গোরা । ১২৩ .....-- --- -- ------- WikitanvirBot (আলাপ) ১৪:১৭, ২৪ মার্চ ২০১৬ (ইউটিসি) ১৪:১৭, ২৪ মার্চ ২০১৬ (ইউটিসি) iাতেই বৃষ্টি আরম্ভ হল। শোদপুর ষ্টেশনে যখন গাড়ি বাহবাও পাই কিন্তু সন্মান পাইনে ; পাওয়াও অসম্ভব ਾਂ, দেখি একটী সাহেবি কাপড় পরা বাঙালী নিজে দাধা দিব্যি ছাতা দিয়ে তার স্ত্রীকে গাড়ি থেকে নাবালে। iীর কোলে একুটা শিশু ছেলে ; গায়ের মোট চাদরটা দিয়ে সেই ছেলেটিকে কোনোমতে ঢেকে খোলা ষ্টেশনের একধারে দাড়িয়ে সে বেচারী শীতে ও লজ্জায় জড়সড় হয়ে ডিৱতে লাগ ল—তার স্বামী জিনিষ পত্র নিয়ে ছাতা মাথায় েিয় স্থাক ডাক বাধিয়ে দিলে। আমার এক মুহুর্তে মনে ড়ে গেল সমস্ত বাংলাদেশে কি রৌদ্রে কি বৃষ্টিতে কি ভদ্র কি অভদ্র কোনো স্ত্রীলোকের মাথায় ছাতা নেই। যখন খেলু স্বামীটা নির্লজ্জ ভাবে মাথায় ছাতা দিয়েছে, আর তার স্ত্রী গায়ে চাদর ঢাকা দিয়ে নীরবে ভিজচে, এই ব্যবiারটাকে মনে মনেও নিন্দ করচে না—এবং ষ্টেশন স্বদ্ধ কোনো লোকের মনে এটা কিছুমাত্র অন্তায় বলে বোধ হচ্চে না তখন থেকে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি আমরা স্ত্রীলোকদের অত্যন্ত সমাদর করি, তাদের লক্ষ্মী বলে দেবী বলে জানি এসমস্ত অলীক কাব্যকণা আর কোনো দিন মুখেও উচ্চারণ ढङ्गस न|।” আনন্দময়ী কহিলেন—“তা হোক্ বিনয়, তাই বলে—” বিনয় অধীর হইয়া কহিল—“না, মা, এ সব তর্কের কথা নয়—আর কিছু দিন আগে হলে আমি নিজেই কোনোমতে এ সব কথা ভাতেই পারতুম না কিন্তু এখন আমি এটা খুবই স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি যে, মেয়েদের আমরা বিশেষভাবে কেবল ঘরের প্রয়োজনের জন্তেই গড়ে তুলেছি— কেবল সেই প্রয়োজনটুকুর মধ্যেই তাদের মৰ্য্যাদা আছে, সেই প্রয়োজনের বাইরে মানুষ বলে তাদের প্রতি দরদ নেই, তাদের প্রতি সন্মান নেই। বিশেষ প্রয়োজনের উপযোগী করে যাকেই আমরা খৰ্ব্ব করব তাকেই আমরা অনাদর না করে থাকতে পারব না—এটা মানুষের ধৰ্ম্ম। গোরা এক একদিন রাগে জলে উঠে বলতে থাকে—যে, ভারতবর্ষের লোককে ইংরেজ কেবল সেইটুকু মানুষ করে তুলতে টাং যেটুকুতে এরা তাদের অধীন হয়ে বিনা আপত্তিতে এবং স্বচারুরূপে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারে। আমরাও ঠিক ততটা পরিমাণে মানুষ হয়ে তাদের কাজ বেশ ভাল করেই চালচ্চি ; এতে মাইনে পাই, মাঝে মাঝে কিন্তু যেই আমরা ইংরেজের প্রয়োজনের সীমা ছাড়িয়ে সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে চাই অমনি তারা আগুন হয়ে ওঠে। তারা বলতে চায় যে তোমরা পৃথিবীর পূবদেশী লোক, স্বভাবতই তোমরা তাবেদারী ছাড়া আর কিছুর যোগ্যই নও, অতএব সে চেষ্টা করলেই মাথা ভেঙে দেব। গোরা একথা মনেও করে না আমাদের দেশের মেয়েদেরও আমরা ঠিক এই রকম করেই থাটো করে রেখেছি—তাই রেখেছি বলে আমরা সমস্ত দেশটাশুদ্ধ যে কত থাটো হয়ে গেছি তা আমরা বুঝতেও পারিনে। কিছুদিন থেকে আমার এই কথা মনে হচ্চে, মা, আমি আর কোনো কাজ করতে পারি বা না পারি, দেশের মেয়েদের অবস্থা যদি কিছুমাত্র উন্নত করতে পারি তা হলে নিজেকে ধন্ত মনে করব। তোমার পায়ের ধূলো নিয়ে তোমার আশীৰ্ব্বাদে এ কাজ আমি করবই। এত দিন পরে আমার মনে হয়েছে, আমার নিজের কাজ আমি খুজে পেয়েছি।” আনন্দময়ী বিনয়ের মাথায় হাত দিয়া কহিলেন “ভগবান তোমার ইচ্ছা পূর্ণ করবেন No বিনয় । আমরা দেশকে বলি মাতৃভূমি, কিন্তু দেশের সেই নারীমূৰ্ত্তির মহিমা দেশের স্ত্রীলোকের মধ্যে যদি প্রত্যক্ষ না করি ; বুদ্ধিতে, শক্তিতে, কৰ্ত্তব্যবোধের ঔদার্য্যে আমাদের মেয়েদের যদি পূর্ণ পরিণত সতেজ সৰল ভাবে আমরা না দেখি —ঘরের মধ্যে দুৰ্ব্বলতা, সঙ্কীর্ণতা এবং অপরিণতি যদি দেখতে পাই তা হলে কখনই দেশের উপলদ্ধি আমাদের কাছে উজ্জল হয়ে উঠবে না । নিজের উৎসাহে হঠাৎ লজ্জিত হইয়া বিনয় স্বাভাবিক স্বরে কহিল, “ম, তুমি ভাৰ্চ, বিনয় মাঝে মাঝে এই রকম বড় বড় কথায় বক্তৃতা করে থাকে—আজো তাকে বক্তৃতায় পেয়েছে। অভ্যাসবশত আমার কথা গুলো বক্তৃতার মত হয়ে পড়ে, আজ এ আমার কিন্তু বক্তৃতা নয়। দেশের মেয়েরা যে দেশের কতখানি, আগে আমি তা ভাল করে বুঝতেই পারিনি—কখনো চিন্তাও করিনি। তারা কেবল ঘরের লোকের মা বোন মেয়ে এই বলেই তাদের জানতুম। কিন্তু তারা যখন মানুষ তখন ঘরের লোকের বাইরেও তাদের সম্বন্ধ আছে, এবং সেই বৃহৎ আত্মীয়তাকে তারা বুদ্ধির সঙ্গে,