পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ꮌ©Ꮼ তোমরা দ্যায়কে কোথাও পীড়িত করিতেছ না, তোমরা স্বভাবসিদ্ধ অবজ্ঞা ও ঔদ্ধত্যের দ্বারা প্রতিদিন তোমাদের উপকারকে উপকৃতের নিকট নিতান্তই অরুচিকর করিয়া তুলিতেছ না, যদি কেবল আমাদের দিকে তাকাইয়া এই কথাই বল যে, অকৃতার্থের অসন্তোষ আমাদের পক্ষে অকারণ অপরাধ এবং অপমানের দুঃখদাহ আমাদের পক্ষে নিরবচ্ছিন্ন অকৃতজ্ঞতা, তবে সেই মিথ্যা বাক্যকে রাজতক্তে বসিয়া বলিলেও তাহা ব্যর্থ হইবে এবং তোমাদের টাইমসের পত্ৰলেখক, ডেলিমেলের সংবাদ-রচয়িত এবং পায়োনিয়র ইংলিশম্যানের সম্পাদকে মিলিয়া তাহাকে ব্রিটিশ পশুরাজের ভীমগর্জনে পরিণত করিলেও সেই অসত্যের দ্বারা তোমরা কোনো শুভফল পাইবেন। তোমার গায়ে জোর আছে বটে তৰু সত্যের বিরুদ্ধেও তুমি চক্ষু রক্তবর্ণ করিবে এত জোর নাই। নূতন আইনের দ্বারা নুতন লোহার শিকল গড়িয়া তুমি বিধাতার হাত বাধিতে পারিবেনা। - অতএব মানবপ্রকৃতির সংঘাতে বিশ্বের নিয়মে যে আবৰ্ত্ত পাক খাইয়া উঠিতেছে তাহার ভীষণত্ব স্মরণ করিয়া আমার প্রবন্ধটুকুর দ্বারা তাহাকে নিরস্ত করিতে পারিব এমন দুরাশা আমার নাই। ছৰ্ব্বদ্ধি যখন জাগ্রত হইয়া উঠে, তখন একথা মনে রাখিতে হইবে সেই দুৰ্ব্বদ্ধির মূলে বহুদিনের বহুতর কারণ সঞ্চিত হইয়া উঠিতেছিল ; একথা মনে রাথিতে হইবে, যেখানে এক পক্ষকে সৰ্ব্বপ্রকারে অক্ষম ও অন্নপায় করা হইয়াছে সেখানে ক্রমশই অপর পক্ষের বুদ্ধিভ্রংশ ও ধৰ্ম্মহানি ঘটা একেবারেই অনিবাৰ্য্য— যাহাকে নিয়তই অশ্রদ্ধা , অসম্মান করি তাহার সহিত ব্যবহার করিয়া মানুষ আত্মসম্মানকে উজ্জল রাথিতে পারেই না—দুৰ্ব্বলের সংস্রবে সবল হিংস্র হইয়া উঠে এবং অধীনের সংস্রবে স্বাধীন অসংযত হইতে থাকে ;–স্বভাবের এই নিয়মকে কে ঠেকাইতে পারে? অবশেষে জমিয়া উঠিতে উঠিতে ইহার কি কোথাও কোনই পরিণাম নাই ? বাধাহীন কর্তৃত্বে চরিত্রের অসংযম যখন বুদ্ধির অন্ধতাকে আনয়ন করে তখন কি কেবল তাহা দরিদ্রেরই ক্ষতি এবং দুৰ্ব্বলেরই দুঃখের কারণ হয় ? প্রবাসী । এইরূপে বাহিরের আঘাতে বহুদিন হইতে দেশের ময় একটা উত্তেজনা ক্রমশই উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিতেছে এী অত্যন্ত প্রত্যক্ষ সত্যটুকুকে কেহই অস্বীকার কড়ি পারবে না। এবং ইংরেজ সমস্ত শাসন ও সতর্কত কেক একটা দিকে, কেবল দুৰ্ব্বলের দিকেই চাপান দিয়া ৷ে একটা অসমতার স্মৃষ্টি করিতেছে তাহাতে ভারতবাসী । সমস্ত বুদ্ধিকে, সমস্ত কল্পনাকে, সমস্ত বেদনাবোধকে অহা । অতিরিক্ত পরিমাণে এই বাহিরের দিকেই, এই একটা নৈমিত্তিক উৎপাতের দিকে উদ্রিক্ত করিয়া রাখিয়াছ তাহাতে সন্দেহ নাই। অতএব, এমন অবস্থায় দেশের কোন কথাটা সকলে চেয়ে বড় কথা তাহা যদি একেবারেই ভুলিয়া যাই অ’ তাহাতে আশ্চৰ্য্য হইবার কিছুই নাই। কিন্তু যাহা প্রাকৃতির তাহা ছৰ্ণিবার হইলেও তাহা সকল সময়ে শ্রেয়স্কর হয় না। হৃদয়াবেগের তীব্রতাকেই পৃথিবীর সকল বাস্তবের চেয়ে বড় বাস্তব বলিয়া মনে করিয়া আমরা যে অনেক সময়েই ভয়ঙ্কা ভ্ৰমে পড়িয়া থাকি-সংসারে এবং নিজের ব্যক্তিগত জীবদে পদে পদে তাহার পরিচয় পাইয়া আসিয়াছি। ইতিহাসেও যে একথা আরো অনেক বেশি থাটে তা স্থিরচিত্তে বিবেচনা করিয়া দেখা কৰ্ত্তব্য। “আচ্ছা, ভাল কথা, তুমি কোনটাকে দেশের সকলো চেয়ে গুরুতর প্রয়োজন বলিয়া মনে কর” এই প্রশ্নটাই অনেকে বিশেষ বিরক্তির সহিত আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন ইহা আমি অনুভব করিতেছি। এই বিরক্তিকে স্বীকা করিয়া লইয়াও আমাকে উত্তর দিতে প্রস্তুত হইতে হইবে। ভারতবর্ষের সম্মুখে বিধাতা যে সমস্তাটি স্থাপিত করা: ছেন তাহা অত্যন্ত হুরূহ হইতে পারে কিন্তু সেই সমস্যাট যে কি তাহা খুজিয়া পাওয়া কঠিন নহে। তাহ নিতান্তী আমাদের সম্মুখে পড়িয়া আছে ; অন্ত দূর দেশের ইতিহাস নজিরের মধ্যে তাহাকে খুজিয়া বেড়াইলে তাহার সদ্ধান | পাওয়া যাইবেন । ভারতবর্ষের পর্বতপ্রান্ত হইতে সমুদ্রসীমা পর্য্যন্ত ীে জিনিষটি সকলের চেয়ে সুস্পষ্ট হইয়া চোখে পড়িতেছে গেট । কি ? সেটি এই যে, এত ভিন্ন জাতি, ভিন্ন ধৰ্ম্ম, ভিন্ন ভা, ভিন্ন আচার জগতে আর কোনাে একটিমাত্র দেশে নাই। [ ৮ম ভাগ। জাঠি | ৩য় সংখ্যা । ] পশ্চিম দেশের যে সকল ইতিহাস ইস্কুলে পড়িয়াছি তাহার কোথাও আমরা এরূপ সমস্তার পরিচয় পাই নাই । রোপে যে সকল প্রভেদের মধ্যে সংঘাত বাধিয়াছিল সে প্রভেদগুলি একান্ত ছিলনা ;–তাহাদের মধ্যে মিলনের ५न একটি সহজতত্ত্ব ছিল যে যখন তাহারা মিলিয়া গেল তখন তাহাদের মিলনের মুখে জোড়ের চিহ্ণটুকু পৰ্য্যস্ত পূজিয়া পাওয়া কঠিন হইল। প্রাচীন যুরোপে গ্ৰীক রোমক গণ প্রভৃতি জাতির মধ্যে বাহিরে শিক্ষা দীক্ষার পার্থক্য তই থাক্ তাহারা প্রকৃতই এক জাতি ছিল। তাহারা পরস্পরের ভাষা, বিদ্যা, রক্ত মিলাইয়া এক হইয়া উঠিবার জন্য স্বতই প্রবণ ছিল । বিরোধের উত্তাপে তাহারা গলিয়া বথনি মিলিয়া গেছে তখনি বুঝা গিয়াছে তাহারা এক দাতুতেই গঠিত। ইংলণ্ডে একদিন স্যাক্সন, নৰ্ম্মান ও কেন্টিক জাতির একত্র সংঘাত ঘটিয়াছিল কিন্তু ইহাদের মধ্যে এমন একটি স্বাভাবিক ঐক্যতত্ত্ব ছিল যে জেতাজাতি জেতারূপে স্বতন্ত্র হইয়া থাকিতে পারিল না ; বিরোধ করিতে করিতেই কখন যে এক হইয়া গেল তাহা জানাও গেল না। অতএব যুরোপীয় সভ্যতায় মামুষের সঙ্গে মানুষকে যে ঐক্যে সঙ্গত করিয়াছে তাঙ্গ সহজ ঐক্য। যুরোপ এখনও এই সহজ ঐক্যকেই মানে—নিজের সমাজের মধ্যে কোনো গুরুতর প্রভেদকে স্থান দিতেই চায় না, হয় তাহাকে মারিয়া ফেলে নয় তাড়াইয়া দেয়। যুরোপের যে কোনো জাতি হোক না কেন সকলেরই কাছে ইংরেজের উপনিবেশ প্রবেশদ্বার উদঘাটিত রাথিয়াছে আর এসিয়াবাসীমাত্রই যাহাতে কাছে ৰ্ঘেষিতে না পারে সে জন্য তাহদের সতর্কতা সাপের মত ক্টো করিয়া ফণা মেলিয়া উঠিতেছে। " যুরোপের সঙ্গে ভারতবর্ষের এইখানেই গোড়া হইতেই অনৈক্য দেখা যাইতেছে। ভারতবর্ষের ইতিহাস যথনি স্বরু হইল সেই মুহূর্তেই বর্ণের সঙ্গে বর্ণের, আর্য্যের সঙ্গে অনার্যের বিরোধ ঘটিল। তখন হইতে এই বিরোধের দুঃসাধ্য সমন্বয়ের চেষ্টায় ভারতবর্ষের চিত্ত ব্যাপৃত রহিয়াছে। আর্য্যসমাজে যিনি অবতার বলিয়া গণ্য সেই রামচন্দ্র দাক্ষিণাত্যে আৰ্য্য উপনিবেশকে অগ্রসর করিয়া দিবার উপলক্ষ্যে যে দিন গুহক চণ্ডালরাজের সহিত মৈত্রী স্থাপন করিয়াছিলেন, যে দিন কিষ্কিন্ধ্যার অনাৰ্য্যগণকে উচ্ছিন্ন না সমস্যা । >6 a করিয়া সহায়তায় দীক্ষিত করিয়াছিলেন, এবং লঙ্কার পরাস্ত রাক্ষসরাজ্যকে নিৰ্ম্মল করিবার চেষ্ট না করিয়া বিভীষণের সহিত বন্ধুতার যোগেশক্রপক্ষের শক্ৰতা নিরস্ত করিয়াছিলেন, সেইদিন ভারতবর্ষের অভিপ্রায় এই মহাপুরুষকে অবলম্বন করিয়ু নিজেকে ব্যক্ত করিয়াছিল। তাহার পর হইতে আজ পর্য্যন্ত এদেশে মানুষের যে সমাবেশ ঘটিয়াছে তাহার মধ্যে বৈচিত্র্যের আর অন্ত রহিল না। যে উপকরণগুলি কোন মতেই মিলিতে চাহে না, তাহাদিগকে একত্রে থাকিতে হইল। এমন ভাবে কেবল বোঝা তৈরি হয় কিন্তু কিছুতেই দেহ বাধিয়া উঠিতে চায় না। তাই এই বোঝা ঘাড়ে করিয়াই ভারতবর্ষকে শত শত বৎসর ধরিয়া কেবলি চেষ্ট করিতে হইয়াছে, বাহারা বিচ্ছিন্ন কি উপায়ে সমাজের মধ্যে তাহারা সহযোগীরূপে থাকিতে পারে ; যাহারা বিরুদ্ধ কি উপায়ে তাহাদের মধ্যে সামঞ্জস্ত রক্ষণ করা সম্ভব হয় ; যাহাদের ভিতরকার প্রভেদ মানব প্রকৃতি কোনোমতেই অস্বীকার করিতে পারে না কিরূপ ব্যবস্থা করিলে সেই প্রভেদ যথাসম্ভব পরস্পরকে পীড়িত না করে ;–অর্থাৎ কি করিলে স্বাভাবিক ভেদকে স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াও সামাজিক ঐক্যকে যথাসম্ভব মান্ত করা যাইতে পারে। নানা বিভিন্ন লোক যেখানে একত্রে আছে সেখানকার প্রতিমুহূর্তের সমস্তাই এই যে, এই পার্থক্যের পীড়া এই বিভেদের দুৰ্ব্বলতাকে কেমন করিয়া দূর করা যাইতে পারে। একত্রে থাকিতেই হইবে অথচ কোনোমতেই এক হইতে পারিব না মানুষের পক্ষে এত বড় অমঙ্গল আর কিছুই হইতে পারে না। এমন অবস্থায় প্রথম চেষ্টা হয় প্রভেদকে সুনির্দিষ্ট গওঁী দ্বারা স্বতন্ত্র করিয়া দেওয়া –পরস্পর পরস্পরকে আঘাত না করে সেইটি সাম্‌লাইয়া যাওয়া ; পরস্পরের চিহ্ণিত অধিকারের সীমা কেহ কোনোদিক্ হইতে লঙ্ঘন না করে সেইরূপ ব্যবস্থা করা। কিন্তু এই নিষেধের গণ্ডিগুলি যাহা প্রথম অবস্থায় বহু বিচিত্রকে একত্রে অবস্থানের সহায়তা করে তাহাই কালক্রমে নানাকে এক হইয়া উঠিতে বাধা দিতে থাকে। তাহা আঘাতকেও বাচায় তেমনি মিলনকেও ঠেকায়। অশাস্তিকে দূরে খেদাইয়া রাখাই যে শাস্তিকে প্রতিষ্ঠা করা তাহা নহে। বস্তুত তাহাতে অশাস্তিকে চিরদিনই কোনো