পাতা:প্রবাসী (ঊনচত্বারিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ \ ২১২ ছেলেমাচুষের উপর এত বড় একটা দায়িত্ব চাপাতে আমার মনে যথেষ্ট দ্বিধা অনুভব— আমি আর বলিতে দিলাম না। বলিলাম-দীকুদা ব্যাপারটা যাই হোক—তোমার সমস্ত বিপদের মধ্যে তোমার দক্ষিণ হস্তের মত লড়াই করবার জন্যে আমি মনকে প্রস্তুত করেছি, অ্যাও ইউ উইল নট ফাইও মি ওয়াণ্টিং। প্রশংসায় এবং কৃতজ্ঞতায় দীনেশের চোখ যেন আমাকে বারংবার অভিনন্দিত করিতে লাগিল । মনে মনে বেশ একটু গৰ্ব্ব ও লজ্জা অমুভব করিলাম। দীনেশ আমার দুষ্ট কধে ধরিয়া মিনিট খানেক দেখিয়া একটু যাচাই করিবার ভঙ্গীতে বলিল—হঁ্যা, পারবে তুমি । চল, গঙ্গার ধারে ঐ পাথরটায় গিয়ে বসা যাক । অনেক কথা বলবার আছে, অল্প সময়ে হবে না । दलिलोंभ-5ल । ૨ দীনেশ বলিতে লাগিল—যশোর জেলার গোলগা গ্রামে নিতাইচরণ মুখোপাধ্যায় নামে এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বাস করিতেন। ব্রাহ্মণ যেমন সদাশয় ও নিষ্ঠাবান তেমনি তেজস্বী। পাড়ার মধ্যে নিতাইচরণের অবস্থা মোটামুটি স্বচ্ছল কিন্তু ব্রাহ্মণ নিঃসন্তান । পরিবারের মধ্যে ব্রাহ্মণী ও কয়েকটি মেনি বিড়াল কু-পোষ্য ব্যতীত আর কেহই ছিল না ; পাড়ার প্রান্তদেশে এক ঘর মুসলমান, তাহারাও আগন্তুক মাত্র। পরিবারে তিনটি মাত্র প্রাণী—আছের, তাহার বুদ্ধামাতা ও মাতৃহীন কন্যা । আছেরের মায়ের অধিকাংশ কাজই ঐ নিতাইচরণের বাড়ীতে ; ঝাড়াই-বাছাই, গোয়াল-উঠান নিকানো প্রভৃতি । মেয়েটির বয়স বছর তিনেক । অমন ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে ভদ্রলোকের ঘরে ৪ মেলা দুষ্কর । শিশুকাল হইতেই দুলালী তার ঠাকুমার আঁচল ধরিয়া নিতাইচরণের বাড়ীর দাওয়ায় বসিয়া আপন মনে খেলাধূলা করে। বড় শাস্ত মেয়েটি। দেখিয়া দেখিয়া নিতাইয়ের পত্নীর কেমন মায়া বসিয়া গিয়াছে । দুলালীও প্রবাসী , Sego তাহাকে দেখিলে বড় খুশী হয়। দিন চলিতেছিল ভালই । এমন সময় এক গ্রীষ্মকালে হঠাৎ ঐটুকু গ্রামে কলেরার মড়ক দেখা দিল। শূন্যপ্রায় পাড়া একেবারেই শূন্ত হইয়া আসিল । আছেরের বৃদ্ধ মাতা দুই দিন ভেদবমি করিয়া চক্ষু বুজিল। যে পারিল পালাইয়া বাচিল । নিতাইচরণ ঘুরিয়া ঘুরিয়া সাধ্যমত সাহায্য করিতে লাগিলেন । শেষে এক দিন শেষ রাত্রে অত্যন্ত পরিশ্রমে এবং অত্যাচারে তিনিও পড়িলেন। নিতাইয়ের পত্নী চক্ষে অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন । গ্রামে একটা ডাক্তার কি বৈদ্য নাই, একলা স্ত্রীলোক কেমন করিয়া যে কি করিবেন কিছুই ঠিক করিয়া উঠিতে পারেন না। এমন সময় আছের আসিল—তাহার কন্যাকে সকাল বেল গিন্নিমার কাছে রাখিয়া কাজে যাইবে ; নঙ্গিলে উপায়৪ ছিল না ; বাড়ীতে কাহার কাছেই বা রাখিয়া যায় । নিতাই-গিন্নি একেবারে আছড়াইলা পড়িলেন—আছের, আমারে বাচা বাবা । এই ভোরবেলায় হ’ল, এখন আর কথা কইতি পারে না । তুষ্ট একবার ওলপুরীর কবরেজ মশায়ুরে ডেক্যে আন বাবা । আছেরকে আর বলিতে হইল না । তার পর পাচ-ছয় দিন ধরিয়া সে যাহা করিল তাহার তুলনা নাই । মৃত্যুর ভুয়ারে দাড়াইয়া ব্রাহ্মণ-মুসলমানে ভেদ রহিল না। যমের সঙ্গে যুঝিয় মুসলমানের সন্তান নিতাইচরণকে ছিনাইয়া আনিল ; কিন্তু নিজেকে রাখিতে পারিল না । তিন দিন ছটফট করিয়া সে চোখ বুজিল । মৃত্যুকালে দুলালীর দিকে চাহিয়া উহার চোখ হইতে অসহায় আশ্র ঝরিয়া পড়িল। তখন তাহার বাকুরোধ হইয়াছে। নিতাইচরণ কষ্টে তাহার নিকট আসিয়া বসিয়াছিলেন । তাহারও চক্ষু শুষ্ক ছিল না। মনের ভাব বুঝিয়া আছেরের হাত ধরিয়া বলিলেন—দুলালীর জন্য ভাবনা ক’রো না বাবা, দুলালী আজ থেকে আমার মেয়ে । একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া আছের চোখ বুজিল । তাহার পর যতদিন নিতাইচরণ বাচিয়াছিলেন মেয়েটিকে তিনি কন্যা নির্বিশেষে প্রতিপালন করিয়াছিলেন ।