পাতা:প্রবাসী (ঊনচত্বারিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শিবায়ন ! Α' ~ হইতে কুরু করিয়াছিল তাহাতে আর সন্দেহ নাই । আমার কথা আর বলিবার নয় ; দুলালীকে আমার নবাজ্জিত যৌবনের সমস্ত শক্তি দিয়া ভালবাসিয়াছিলাম। তাহার সামান্য আমুকুল্য লাভ করিবার জন্য আমি সৰ্ব্বস্ব দিতেও কুষ্ঠিত হইতাম না । বলিয়াছি, এক পক্ষে আমার কপালটা ভালই ছিল। এক বৎসর না যাইতেই পোস্টাপিসে একটা চাকুরী জুটিয়া গেল। দিন চলিতেছিল মন্দ নয়। শাশুড়ীর অর্থ এবং আমার উপার্জনে মিলিয়া স্বচ্ছন্দে চলিয়া যাইতেছিল । কিন্তু দুলালীর শরীরটা বিবাহের পূৰ্ব্বে সেই যে ভাঙিয়াছিল বহু ষত্বেও তাহা যেন আর জোড়া লাগিতেছিল না। তাই বৈকালে নিয়ম করিয়া দুলালীকে লইয়া বেড়াইতে যাইতে আরম্ভ করিয়াছিলাম । একদিন অসি হইতে অল্প দূরে তুলসীঘাটের ও পারে রামনগরের বালুচরের দিকে চাহিয়া বসিয়া আছি। দুলালীর একখানি স্বন্দর ছোট হাত তাহার নিরাপত্তিতে নিজের হাতে তুলিয়া লইয়াছি। প্রাণে অপরূপ তৃপ্তি। অকস্মাং দুলালীর একটা অস্ফুট চীংকারে চমকিয়৷ তাহার দিকে চাহিলাম। বিস্ফারিত চোখে সে একদুষ্টে নদীর মধ্যে চাহিয়া আছে। সেখানে এমন অভিনব কিছুই দেখিতে পাইলাম না। একখানি খেয়ানৌকা— তাহাতে দুইটি মাত্র আরোহী। এক জন মাঝি এবং অপর জন একটি ভদ্রলোক । দুলালীকে একটু ঠেলা দিয়া বলিলাম—কি ? কি হয়েছে ? চমক ভাঙিয়া দুলালী অন্য দিকে চাহিল । বলিল— কিছু না। বাড়ী চল, শরীরটা ভাল বোধ হচ্ছে না। ইহার পর দুলালী যেন আরও দুৰ্ব্বোধ্য হইয়া উঠিল। রাত্রে মাঝে মাঝে উঠিয়া এ-ঘর ও-ঘর ছাতে বারান্দায় পায়চারি করিয়া বেড়াইত । বলিত-ঘুম আসছে না। তুমি গিয়ে শোও। কাল আবার তোমার আপিস করতে হবে । এক দিন রাত্রে জাগিয়া দেখি দুলালী বিছানায় নাই। চুপ করিয়া পড়িয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। অনেক ক্ষণ পরে দুলালী আসিল । হঠাৎ একটা চমৎকার গন্ধে ঘরটা যেন ভরিয়া গেল। গন্ধটা কাঠালীচাপার। আমাদের পাশের পোড়ো বাড়ীটার বাগানে একটা গাছে অজস্ৰ ফুটিয়া ছিল। গন্ধটা বোধ করি বাতালে বহিরা আনিতেছে। দেখিতে আমার ভুল হয় নাই-মাথার খোপা হইতে একটা কিছু খুলিয়া লইয়া সে নিঃশব্দে তাহার কাপড়ের বাক্সে নিয়া রাখিল ৷ এথন জানি সেটা এক গোছা চাপাফুল। কিন্তু তখন আমি এ-কথা চিন্তাও করি নাই। স্ত্রীলোকের প্রসাধনের কোন দ্রব্য হইবে এই ভাবিয়াছিলাম। হায়রে প্রেম, তুমিই এমনি অন্ধ করিয়া রাখ ! তার পর এক দিন, মেঝের উপর কুড়াইয়া পাওয়া এক টুকরা ছিন্ন পত্রখণ্ড আমার স্বরচিত তাসের প্রাসাদ অকস্মাং চূর্ণ চূর্ণ করিয়া দিল। দুলালী কোন কথাই অস্বীকার করিল না। দুলালীর মাকে বলিলাম-জেনেশুনে আমার এমন সৰ্ব্বনাশ কেন করলেন ? উত্তর শুনিলাম--কি ন্যাক বাছা তুমি । আহাহা, কি না জানতে তুমি, শুনি ? তথন কি আর জ্ঞানগম্যি কিছু ছিল ? এখন আমারই ঘাড়ে বসে খেয়েদেয়ে পায়ের উপর পা দিয়ে বড় যে, ইত্যাদি ইত্যাদি । আর অপেক্ষা করিলাম না । সোজা বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গেলাম। আশ্চৰ্য্য ! দুলালীর জন্য তখনও বুক ফাটিতেছিল এবং নিজের উপর ক্রোধে যেন নিজকে দংশন করিতে ইচ্ছা হইতেছিল । মনে হইতেছিল ছুট দিয়া এক দিকে কোথাও চলিয়া যাই । ঘুরিতে ঘুরিতে দশাশ্বমেধ ঘাটে আপিসের একটি বন্ধুর সহিত দেখা হইল । সেদিন রবিবার। সে বলিল—চললাম ভাই সাগর-পার । আর ফিরি কি ন-ফিরি । অবাক হইয়া জিজ্ঞাস করিলাম--তার মানে ? —মানে, মেসোপটেমিয়ায় যাচ্ছি। . মনে পড়িয়া গেল কিছুদিন হইতেই কনসক্রিপশন চলিতেছিল। মেসোপটেমিয়া! মেসোপটেমিয়া! হঠাৎ যেন একটা পথের সন্ধান মিলিল । মেসোপটেমিয়া! মাথার মধ্যে কথাটা জমিয়া বসিল । দিন দুই গেল জোগাড়যন্ত্রে । তার পর একদিন একেবারে বম্বে গিয়া জাহাজে চড়িয়া বসিলাম । সম্মুখে উদার সিন্ধু, উদ্ধে অনন্ত আকাশ, চতুদিকে বিরাট ব্যাপ্তি। দুলালীর জন্ম