পাতা:প্রবাসী (ঊনচত্বারিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৩৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পৌষ , অনুভূতি

  • 83

আবার ফিরিয়া আসিয়া মনের মধ্যে বাসা বাধিল । আমি বিষণ্ণ বদনে বিষাদ উপভোগ করিয়া চলিলাম। সুলেখা ও আমার পরস্পরের সম্বন্ধে দুৰ্ব্বলতার খোজ আর কেহ রাখে না ।" রাখা নিরাপদও নয়, অর্থাৎ আমাদের দু-জনের দিক দিয়া । এক-এক সময়ে সন্দেহ হয় আমরা নিজেরাই জানি কিনা ৷ লক্ষ্মীপূজার দিন সকাল বেলায় ছোটবোন আসিয়া খবর দিল, “স্থলেখাদি চিঠি লিখেছে।” চমকিয়া বলিলাম, “ কাকে ? আমাকে ?” সে পরমবিস্ময়ে বলিল, “আই! তোমাকে কেন, আমার কাছে লিখেছে । তোমার কথাও আছে, এই দেখো না ।” সে সযত্বে চিঠির দুই পাশ ভাজ করিয়া মাঝের পাচ-ছয় লাইন দেখাইল ; যেন বাকী লাইন-কটার সম্বন্ধে আমার বিন্দুমাত্রও কৌতুহল আছে! স্থলেখা লিখিয়াছে— “—মণীশদা আমার পরে খুব রাগ করেছে ? না ? তাকে ব’লো, আমি সেদিন রাগের মাথায় যা-তা বলেছি, তার জন্যে সে যেন ক্ষমা করে । আমার ভারি মন খারাপ হয়েছে । এখানে এলে হাতজোড় ক’রে ক্ষমা চেয়ে নেব।” বোন ভালমানুষের মত বলিল, “এ-সব কি লিখেছে স্থলেখাদি । তোমার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল বুঝি ? বল নি ত! ধাকু গে, মা চিঠিখানা চেয়েছিলেন, দিই C? יין তাহার হাত হইতে চিঠিখানি লইয়া তিন-চার টুকরা করিয়া পকেট রাখিয়া দিলাম, ভবিষ্যতের অগ্নি সংস্কারের জন্য। সে মুখ টিপিয়া হাসিয়া চলিয়া গেল। সন্দেহ হইল, অরুণাকে যতটা ভালমামুষ ভাবি, ততটা সে ቖ፪ ! এত ক্ষণে মনের মধ্যে হাতড়াইয়া দেখিলাম, যেদুঃখটাকে পরমযত্নে মনের মধ্যে জিয়াইয়া রাখিয়াছিলাম, স্বলেখার চিঠির ছয় লাইনের মন্ত্রবলে তাহা কোথায় উবিয়া গিয়াছে । অত্যন্ত অসহায় বোধ করিলাম। দেখিলাম, একটি পোষা দুঃখ মনের স্বাস্থ্যরক্ষায় অনেকটা সাহায্য করে। এখন তাহার একান্ত অনুপস্থিতিতে এবং আকস্মিক অন্তৰ্দ্ধানে নিরুপায় হইয়া হাত-মুখ ধুইতে পুকুরপাড়ে রওনা হইলাম। একটা আমের ডাল ভাঙিয়া দাতন করিতেছি, এমন সময় দূর হইতে দেখিলাম আমেজ আসিতেছে। ষেকারণেই হউক, সম্ভবতঃ মন খারাপ হওয়ার কারণ মন হইতে দূরীভূত হওয়াতেই তাহাকে দেখিয়া বিরক্ত হইয়া উঠিলাম, এখনও সাতটা বাজে নাই, ইহারই মধ্যে তাগাদ দিতে আসিয়াছে। সে যে গত কয়েক দিন যাবৎ একেবারেই তাগাদ দেয় নাই, সে কথা মনে পড়িল না। কাছে আসিয়া নিঃশব্দে একটা সিড়ির ধাপের উপর বসিল । আমি সবেগে দস্তুধাবন করিতে লাগিলাম । এমন সময়ে আমেজের মুখের উপর চোখ পড়ায় একটু অবাক হইলাম আমেজ আরও বুড়া হইয়া পড়িয়াছে, এই ক-দিনেই । গালের মাংস আরও ঝুলিয়া পড়িয়ছে, চক্ষু অধিকতর কোটরগত হইয়াছে। বলিলাম, “জর হয়েছিল নাকি ?” সে ঘাড় নাড়িল । আমি মুখটা ধুইয়া লইলাম। “জর হয় নি ত চেহারা ওরকম হয়েছে কেন ?” সে একটু শ্রাস্তস্বরে বলিল, “ম্যায়েড গলায় দড়ি लिंडेल-” অসহিষ্ণু হইয়া বলিলাম, “সে ত কোন হোসেন শার আমলে দিয়েছিল, সে-কথা শুনতে চাচ্ছি না। ভালো কথা, তোমাকে পাচ টাকা দিতে পারব না, তিনটে টাকা পারি। চলবে ?” কহিল, “তাই দ্যান । ম্যায়েডা—” মন বিদ্রোহ করিয়া উঠিল। সহিষ্ণুতার একটা সীমা আছে । বলিলাম, “ম্যায়েডী—কি ?” “পরশু গলায় দড়ি দিইল, এবারে মরিছে।” মুহূৰ্ত্তকাল নিৰ্ব্বাক হইয়া রহিলাম। সহসা সানন্দে দেখিলাম, আমার একটি প্রিয় দুঃখ অন্তহিত হইলেও, আর একটি নূতন পাইয়াছি। যথোপযুক্ত সহানুভূতি দেখাইলাম । তিনটা নহে, পুরা পাচটা টাকা আনিয়া দিলাম। সিগারেট কমাইতে হইবে।