পাতা:প্রবাসী (ঊনচত্বারিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৩৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পৌষ সত্যই যেন কালী খল খল করিয়া হাসিতেছে। কালী এবার ভয়ঙ্করী হইয়া উঠিয়াছে । গত দুই বৎসর কালীর বন্যা তেমন প্রবল হয় নাই, এবার আষাঢ়ের প্রথমেই ভীষণ বন্যায় কালী ফাপিয়া ফুলিয়া রাক্ষসীর মত হইয়া উঠিল । বর্ষাও নামিয়াছে এবার আষাঢ়ের প্রথমেই । জ্যৈষ্ঠ-সংক্রাস্তির দিনই আকাশের ভ্ৰাম্যমাণ মেঘপুঞ্জ ঘোরঘটা করিয়া আকাশ জুড়িয়া বসিল । বর্ষণ আরম্ভ হইল অপরাহ্ল হইতেই । পরদিন সকাল—অর্থাৎ পয়লা আষাঢ়ের প্রাতঃকালে দেখা গেল—মাঠঘাট জলে থৈ থৈ করিতেছে । ধান চাষের *কাড়ান’ লাগিয়া গিয়াছে । ইহাতেই কিন্তু মেঘ ক্ষাস্ত হইল না, তিন-চার দিন ধরিয়া প্রায় বিরামহীন বর্ষণ হইয়া গেল । কখনও প্রবল ধারায়, কখনও বা রিমিঝিমি, কখনও অতি স্বল্প ফিন্‌কির মত বৃষ্টির ধারাগুলি বাতাসের বেগে কুয়াশার বিন্দুর মত ভাসিয়া যাইতেছিল । অনেক কালের লোকেও বলিল—এমন স্বষ্টিছাড়া বর্ষা তাহারা জীবনে দেখে নাই । এ-বর্ষাটির না আছে সময়জ্ঞান, না আছে মাত্রীজ্ঞান | দেখিতে দেখিতে কালীর বুকে বন্যাও আসিয়া গেল ঝড়ে হাওয়ার মতই। এ-বেলা ও-বেলা বান বাড়িতে বাড়িতে রায়হাটের তালগাছ-প্রমাণ উচু ভাঙা কুলের কানায় কানায় হইয়া উঠিয়াছে ; ভাঙা তটের কোলে কোলে কালীর লাল জল সুর্য্যের আলোয় রক্তাক্ত ছুরির মত ঝিলিক হানিয়া তীরের মত গতিতে ছুটিয়া চলিয়াছে । মধ্যে মধ্যে খানিকটা করিয়া রায়হাটের কূল কাটিয়া ঝুপ ঝুপ শব্দে খসিয়া পড়িতেছে । রায়হাটের চাষীরা বলে—কালী জিব দিয়ে চাটছে, স্বাক্ষুসীর মত। ভাগ্যে আমাদের কাকরে মাটি । সত্য কথা। রায়হাটের ভাগ্য ভাল যে, রায়হাটের বুক সাওতাল পরগণার মত কঠিন রাঙামাটি ও কাকর দিয়া গড় ! নরম পলিমাটিতে গঠিত হইলে কালীর শাণিত জিহার লেহনে কোমল মাটির তটভূমি হইতে বিস্তৃত ধ্বস কোমল দেহের মাংসপিণ্ডের মত খসিয়া পড়িত । স্বায়হাট ইহারই মধ্যে কঙ্কালসার হইয়া উঠিত। দুই-তিন বৎসরে কালী মাত্র হাত-পাচেক পরিমিত কুল রায়হাটের

  • कालिग्लैंौ ५

yh কোলে কোলে খাইয়াছে। কিন্তু এবার এই বন্যাতেই ইহারই মধ্যে হাত-দুয়েক খাইয়া ফেলিয়াছে—এখনও পূর্ণ ক্ষুধায় খাইয়া চলিয়াছে । ওপারে চরটাও এবার প্রায় চারি পাশ বন্যায় ডুবিয়া ছোট একটি দ্বীপের মত কোন মতে জাগিয়া আছে। চরের উপরেই এখন কালীনদীর খেয়ার ওপারের ঘাট-ঘাট হইতে একটা কঁাচা রাস্তা চলিয়া গিয়াছে চরের ওদিকের গ্রাম পৰ্য্যন্ত । সেই পথটা মাত্র একটা যোজকের মত জাগিয়া আছে । চরের উপর শ্রীবাস পাল যে দোকানটা করিয়াছে, সেই দোকানের দাওয়ায় সাওতালদের মাতব্বর কয় জন বসিয়া অলস উদাস দৃষ্টিতে এই দুৰ্য্যোগের আকাশের দিকে চাহিয়া নিৰ্ব্বাক্ হইয়া বসিয়া ছিল । কমল মাঝি, সেই কাঠের মিস্ত্রী রহস্তপ্রবণ ওস্তাদও বসিয়া আছে । জনদুয়েক নীরবে চুটি টানিতেছিল। শালপাতায় জড়ানো কড়া তামাকের বিড়ি উহারা নিজেরাই তৈয়ারী করে, উহারা বলে 'চুটি । কড়া তামাকের কটু গন্ধে জলসিক্ত ভারী বাতাস আরও ভারী হইয়া উঠিয়াছে। মধ্যে মধ্যে দুই-চারি জন রাহী খেয়াঘাটে যাইতেছে বা খেয়াঘাট হইতে আসিতেছে । দোকানের তক্তাপোষের উপর শ্ৰীবাস নিজে একখানা খাতা খুলিয়া গম্ভীর ভাবে বসিয়া আছে । ওপাশে শ্ৰীবাসের ছোট ছেলে একখানা চাটাই বিছাইয়া দোকান পাতিয়া বসিয়াছে, তাহার কোলের কাছে একটা কাঠের বাক্স, এক পাশে একটা তেরাজু—ওজনের বাটখারাগুলি সেরের উপর আধ সের তাহার উপর এক পোয় তাহার পর আধ পোয়া —এমনি ভাবে আধ ছটাকটিকে চূড়ায় রাখিয়া মন্দিরের আকারে সাজাইয়া রাখিয়াছে । সহসা এই নীরবতা ভঙ্গ করিয়া শ্ৰীবাসই বলিল—কি রে সবাই যে তোরা থম্ব মেরে গেলি ! কি বলছিস বল, আমার কথার জবাব দে । কমল নির্লিপ্তের মত উত্তর দিল—কি বুলব গো, আপুনি যে যা-তা বুলছিস গো ! শ্ৰীবাসের কপাল একেবারে প্রশস্ত টাকের প্রান্তদেশ পৰ্য্যস্ত কুঁচকাইয়া উঠিল—বিস্ময়ের স্বরে সে বলিয়া উঠিল— আমি যা-ত বলছি ! আপনার পাওনাগগু চাইলেই