পাতা:প্রবাসী (ঊনচত্বারিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৪৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মাঘ কালিন্দী থাকে কালী-নামাবলী, সম্মুখে থাকে নারিকেলের খোলার একটি পাত্র আর থাকে মদের বোতল ও কিছু খাদ্য-মৎস বা মাংস ৷ এক-এক বার নারিকেলের মালার পাত্রটি পরিপূর্ণ করিয়া লইয়া জপতপ ও নানা মুদ্রাভঙ্গিতে তাহা শোধন করিয়া লইয়া পান করেন, তাহার পর আবার আরম্ভ করেন ধ্যান ও জপ ; একটি নির্দিষ্টসংখ্যক জপ শেষ করিয়া, আবার দ্বিতীয় বার পাত্র পূর্ণ করিয়া ঐ ক্রিয়ারই পুনরাবৃত্তি করেন । এমনি ভাবে তিন বারে তৃতীয় পাত্র শেষ করিয়া তিনি সান্ধ্যকৃত্য শেষ করেন, কিন্তু ইহাতেই তাহার দেড় ঘণ্ট হইতে দুই ঘণ্টা কাটিয়া যায়। তিন পাত্রের অধিক তিনি সাধারণত: পান করেন না । হেমাঙ্গিনী স্বামীর সান্ধ্যকৃত্যের আয়োজন করিয়াই রাখিয়াছিলেন, ইন্দ্র রায় আসিয়া কাপড় বদলাইয়া আসন গ্রহণ করিতেই তিনি গৃহদেবী কালীমায়ের প্রসাদী কিছু মাছ আনিয়া নামাইয়া দিলেন । রায় বলিলেন—দেখ, অচিন্ত্যবাবুকে আঙ্গ নেমস্তন্ন করেছি ; তার জন্তে দুধ একটু ঘন ক’রেই জাল দিয়ে রেখো। ভদ্রলোক আফিং ধরেছেন, ঘন দুধ না হ’লে তৃপ্তি হবে না । হাসিয়া হেমাঙ্গিনী বলিলেন—বেশ । কিন্তু আর কাউকে নেমস্তন্ন কর নি তো ? তোমার তো আবার নারদের নেমস্তন্ন ! —ন । রায় একটু হাসিলেন । হেমাঙ্গিনী বলিলেন—আজ তুমি কি এত ভাবছ বল তো ? —না:, ভাবি নি কিছু। রায়ের কথার স্বরের মধ্যে একটি ক্ষীণ ক্লাস্তির আভাস ফুটিয়া উঠিল বলিয়া হেমাঙ্গিনীর মনে হইল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কুষ্ঠিতভাবে হেমাঙ্গিনী বলিলেন—অমল ছেলেমানুষ, সে কাজটা ছেলেমানুষী ক’রেই করেছে ; সেটা— ত্রস্তভাবে বাধা দিয়া রায় বলিলেন—ও কথা উচ্চারণ ক’রো না হিমু ; তুমি কি আমাকে এমন সংকীর্ণ ভাব ? এই সন্ধ্যা করবার আসনে ব’সেই বলছি হিমু, সত্যিই আমার আর কোন বিদ্বেষ নাই, রামেশ্বর বা তার ছেলেদের উপর। সুনীতির বড়ছেলে রাধারাণীর মর্য্যাদা রাখতে যা করেছে তাতে রাধুর গর্তের সস্তানের সঙ্গে তাদের কোন পার্থক্য আর থাকতে দেয় নি । হেমাঙ্গিনী চুপ করিয়া রহিলেন, কোন উত্তর দিতে মন যেন তাহার সায় দিল না । রায় হাসিয়া বলিলেনতা হ’লে আমি সন্ধ্যাটা সেরে নি, তুমি নিজে দাড়িয়ে রান্নাবান্নাটা দেখে দাও বরং ততক্ষণ ! হেমাঙ্গিনী চলিয়া গেলেন । রায় একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ইষ্টদেবীকে পরম আস্তরিকতার সহিত স্মরণ করিয়া ডাকিয়া উঠিলেন— তারা, তারা । সবই তোমারই ইচ্ছা মা ! তার পর তিনি শাস্ত্রবিধান অনুযায়ী ভঙ্গিতে আসন করিয়া বসিয়া সান্ধ্যকৃত্য আরম্ভ করিলেন । হেমাঙ্গিনীর ভুল হইবার কথা নয় । দুৰ্দ্দাস্ত কৌশলী হইলেও ইন্দ্র রায় হেমাঙ্গিনীর নিকট ছিলেন সরল উদার মহৎ । এক বিন্দু কপটতার ছায়া কোন দিন তাহার মনোলোকে ছায়াবৃত করিয়া হেমাঙ্গিনীর দৃষ্টিকে বিভ্রাস্ত বা প্রতারিত করে নাই । অমল অহীন্দ্রকে নিমন্ত্রণ করিয়াছে-এই সংবাদটা শুনিবামাত্র রায়ের ভ্র কুঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল । প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করিয়া সামাজিক নিমন্ত্রণ-ব্যবহার বন্ধ না হইলেও ছোট রায়-বাড়ী ও চক্রবত্তা-বাড়ীর মধ্যে এ ব্যবহারটা রাধারাণীর নিরুদ্দেশের পর হইতেই প্রকৃতপক্ষে বন্ধই ছিল । সামাজিক ক্রিয়াকলাপে দুই বাড়ীই ব্রাহ্মণ কৰ্ম্মচারী বা আপন আপন পূজক ব্রাহ্মণ পাঠাইয়া সামাজিক দায়িত্ব রক্ষা করিতেন। তাহার পর অকস্মাৎ যেদিন ইন্দ্র রায়েরই নিয়োজিত ননী পাল চক্রবত্তীদের অপমান করিতে গিয়া রায়ংশের কন্যারই অপমান করিয়া বসিল এবং সে-অপমানের প্রতিশোধ চক্রবভী-বংশের সস্তান মইীন্দ্র তাহাকে হত্য করিয়া ফাসি বরণ করিয়া লইতেও প্রস্তুত হইল—সেদিন হইতে ইন্দ্র রায় যাহা কিছু করিয়া আসিতেছেন সে সমস্ত দানের প্রতিদান হিসাবেই করিয়া আসিতেছেন । অন্ততঃ তাহার মনের সেই ধারণাই ছিল । অহীন্দ্র এখানে আসিলে জল খাইয়া যাইত বা অমল চক্রবর্তী-বাড়ীতে কিছু থাইয়া আসিত—তাহার অতি অল্পই তিনি জানিতেন বেশীর ভাগই ছিল তাহার অজ্ঞাত। যেটুকু জানিতেন,