পাতা:প্রবাসী (ঊনচত্বারিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৫৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ফাগুন কত আর সহ করা যায়। তা ছাড়া এ-মাসের মাইনেটা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা যখন আর নেই, তখন সহ ক’রেই বা আর লাভ কি। বললাম, “মিছিমিছি মুখ খারাপ করবেন না বিশ্বাস-মশাই। ভদ্রলোকের মত কথা বলবেন । আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি, কিন্তু ছেলে আপনার একটি রত্ন, আমি কি করব বলুন " “কি বললে কি-কি—” “কিছু না । ভদ্রলোকের মত এ-মাসের মাইনেট দিয়ে দিন ।” “মাইনে ? আবার মাইনে ? লজ্জা করে না চাইতে ?” “লজ্জা কিসের ? পরিশ্রম করেছি তার স্থায্য পারিশ্রমিক দেবেন। লজ্জা বরং আপনারই করা উচিত।” বিশ্বাস-মশাই এর উত্তরে অত্যন্ত কঠিন একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, সাত-আট বছরের একটি কালো রোগ মেয়ে দোতলা থেকে সিড়ি বেয়ে তর-তর ক’রে নেমে এসে র্তার সামনে দাড়াল । "কিরে শীতলা ?” “ম ডাকছে মাষ্টার-মশাইকে ।” “মাষ্টার-মশাইকে ? কেন মাষ্টার-মশাইকে দিয়ে তার আবার কি দরকার ?” “মা বললে দরকার আছে। চলুন মাষ্টার-মশাই ।” কেমন যেন একটু সঙ্কোচ বোধ করলাম। তাকালাম বিশ্বাস-মশায়ের দিকে । “যাও শুনে এস । তো আর-* মেয়েটির পিছনে পিছনে সিড়ি বেয়ে উঠে চললাম । মাঝারি সাইজের পাশাপাশি কয়েকটি ঘর । তারই একটি ঘরের সামনে মেয়েটি এসে থেমে দাড়াল। “মাষ্টারমশাই এসেছেন মা।” দরজাটা আলগা ভাবে বন্ধ করা ছিল, ভিতর থেকে কে খুলে দিলেন। "এস বাব ঘরের মধ্যে এল । তুমি তো আমার ছেলের মত। লজ্জা কি!” খুব মৃদু আর চাপা গলা। মনে হ’ল কথাটা বোধ হয় নিজেকেই বললেন । কপাল পর্য্যস্ত ঘোমটা টানা, এক বার আমার দিকে চেয়েই চোখ নামিয়ে নিলেন । হুকুম যখন এক বার হয়েছে তখন পরীক্ষা vege বললেন, “বস বাবা এখানে এসে।” কি চমৎকার চোখ, আর কি মিষ্টি কথা বলবার ধরণ ! বুঝলাম কেন হুকুম অমান্য করবার ক্ষমতা নেই বিশ্বাস মশায়ের । র্তার নির্দেশমৃত বসলাম গিয়ে ঘরের মধ্যে। তিনি এক মুহূৰ্ত্ত চুপ করে রইলেন। সবুজ রঙের একটা আলো জলছে। ঘরের মেঝেতে বিছানা পাতা । তাতে শোয়ান রয়েছে সারি সারি কয়েকটি মানা আকারের মাংসপিণ্ড । র্তার নিজের গায়ে মাংস নেই। আছে সাবেকি আমলের ভারী ভারী গহনা। একটু পরে তিনি বললেন, "উনি বুঝি তোমাকে কি সব বলছিলেন না ? কিছু মনে করে। না বাবা। ওঁর মাথার ঠিক নেই।” দেয়ালের দিকে চেয়ে বললাম, “না মনে করবার কি আছে।” “রাগলে আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না, কাকে ষে কি বলেন কিছু খেয়াল নেই । তোমার আর কি দোষ, সৰ আমার ভাগ্য । মা-কালী গঙ্গাকে এত ক’রে ডাকলাম কেউ মুখ তুলে চাইলেন না। ছেলেটা সারাদিন না খেয়ে দরজায় খিল দিয়ে পড়ে রয়েছে। এত ডাকাডাকি সাধাঁসাধি কিছুতেই দোর খুলল না। পৃথিবীতে ও-ই যেন একমাত্র ফেল করেছে। তুমিই বল তো বাবা, ধারা পরীক্ষণ দেয় তাদের সবাই-ই কি পাস করে ? কেউ পাস করবে, কেউ ফেল করবে এই জন্যই তো পরীক্ষা নেওয়া ? তুমি দেখ তো বাবা ডেকে এনে ওকে কিছু খাওয়াতে পার কি না । সারাদিন এক ফোটা জল পৰ্য্যন্ত পেটে যায় নি।” পড়াশুনোর দিকে তেমন আগ্রহ এ-বাড়ীর কারও মধ্যেই লক্ষ্য করি নি। কিন্তু পরীক্ষায় ফেলের কলঙ্ক কি মৰ্ম্মাস্তিক ভাবেই না এরা অমুভব করছেন । বাড়ীতে মৃত্যুর মতই যেন ভয়ঙ্কর একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে । জিজ্ঞাসা করলাম, “মমু কোথায় ?” “এস আমার সঙ্গে” ব’লে বেরিয়ে কয়েক পা এগিয়ে পাশের ঘরে রুদ্ধ দরজায় মৃদু আঘাত ক’রে ডাকলেন, “মহু ওঠ, তোর মাষ্টার-মশাই ডাকছে তোকে ।” ঘরের ভিতর থেকে কোন সাড়া এল না । আমি এগিয়ে এলাম, “মনোরঞ্জন, শোন, দোর খোল।”