পাতা:প্রবাসী (ঊনচত্বারিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৬৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ফাস্তুল পল্লীসেবা 9 وتايانا মঙ্গলচেষ্টার বীজ নিহিত সেই জ্ঞানের দিকেই পল্লীবাসীদের শহরবাসীদের থেকে পৃথক করে রাখা হয়েছে। অন্য কোনো দেশে পল্লীতে শহরে জ্ঞানের এমন পার্থক্য রাখা হয় নি, পৃথিবীর অন্যত্র নবযুগের নায়ক র্যারা নিজেদের দেশকে নূতন ক’রে গড়ে তুলছেন তারা জ্ঞানের এমন পংক্তিভেদ কোথাও করেন নি, পরিবেশনের পাতা একই । আমাদের দেশে একই ভাবে যে সমস্ত দেশকে অকুপ্রাণিত করা যাবে এমন উপায় নেই। আমি তাই যারা এখানে গ্রামের কাজ করতে আসেন তাদের বলি, শিক্ষাদানের ব্যবস্থ! যেন এমন ভাব মনে রেখে না করা হয় যে ওরা গ্রামবাসী, ওদের প্রয়োজন স্বল্প, ওদের মনের মতো ক’রে যা হয় একটা গেয়ো ব্যবস্থা করলেই চলবে। গ্রামের প্রতি এমন অশ্রদ্ধা প্রকাশ যেন আমরা না করি। দেশের মধ্যে এই যে প্রকাও বিভেদ একে দূর করে জ্ঞানবিজ্ঞান কি পল্লী কি নগর সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে, সর্বসাধারণের কাছে সুগম ক’রে দিতে হবে । গ্রামের লোকেরা থাকুক তাদের ভূতপ্রেতওঝা তাদের অশিক্ষা অস্বাস্থ্য নিরানন্দ নিরে, তাদের জন্য শিক্ষার একটুখানি যে-কোনো রকম আয়োজন করলেই যথেষ্ট, এ রকম অসম্মান যেন গ্রামবাসীদের না করি । এই অসম্মান জন্মায় শিক্ষার ভেদ থেকে, মন অহংকৃত হয়, বলে, ওরা চালিত হবে আমরা চালনা করব, দূর থেকে উপর থেকে । এর ফলে অনেক সময় শিক্ষিত পল্লীহিতৈষীরা চাষীদের কাছে এমন সব বিষয়ে মুখস্থ-করা উপদেশ দিতে আসেন হয়ত যে বিষয়ে চাষীরা তাদের চেয়ে ভালোই জানে। এর একটা দৃষ্ঠাস্ত দিই। এক সময়ে আমার মনে হয়েছিল যে শিলাইদহে আলুর চাষ বিস্তৃতভাবে প্রচলন করব । আমার প্রস্তাব শুনে কৃষি-বিভাগের কতৃপক্ষ বললেন যে আমার নির্দিষ্ট জমিতে আলুর চাষ করতে হ’লে এক-শ মণ সার দরকার হবে ইত্যাদি। আমি কৃষি-বিভাগের প্রকাও তালিকা অনুসারে কাজ করলুম ফসলও ফলল কিন্তু ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের কোনোই সামঞ্জস্য রইল না। এ-সব দেখে আমার এক চাষী প্রজা বললে, আমার পরে ভার দিন বাবু—সে কৃষি-বিভাগের তালিকাকে অবজ্ঞা করেও প্রচুর ফসল ফলিয়ে আমাকে লজ্জিত করলে । আমাদের শিক্ষিত লোকদের জ্ঞান যে নিষ্ফল হয়, অভিজ্ঞতা যে পল্লীবাসীর কাজে লাগে না, তার কারণ আমাদের অহমিকা, যাতে আমাদের মিলতে দেয় না, ভেদকে জাগিয়ে রাখে। তাই জামি বারংবার বলি, গ্রামবাসীদের অসম্মান কোরো না, যে-শিক্ষায় আমাদের প্রয়োজন তা শুধু শহরবাসীদের জন্য নয়, সমস্ত দেশের মধ্যে তার ধারাকে প্রবাহিত করতে হবে। সেট যদি শুধু শহরের লোকদের জন্য নির্দিষ্ট থাকে তবে তা কখনো সার্থক হ’তে পারে না। মনে রাখতে হবে শ্রেষ্ঠত্বের উৎকর্ষে সকল মামুষেরই জন্মগত অধিকার, গ্রামে গ্রামে আজ মানুষকে এই অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। আজ আমাদের সকলের চেয়ে বড়ো দরকার শিক্ষার সাম্য । অর্থের দিক্ দিয়ে এর ব্যাঘাত আছে জানি, কিন্তু এ ছাড়া কোনো পথও নেই। নূতন যুগের দাবী মেটাতেই হবে। আমরা নিজেরা অক্ষম, আমাদের সাধ্য সংকীর্ণ তবু সেই স্বল্প ক্ষমতা নিয়েই এই ক’খানি গ্রামের মধ্যে আমর! একটা আদর্শকে স্থাপনা করবার চেষ্টা করেছি । বন্থ বৎসর অভাবের সঙ্গে সংগ্রাম ক’রে আমরা গ্রামবাসীদের অমুকুল করেছি। ক্ষেত্র এখন প্রস্তুত, আমাদের সামনে যে বড়ে আদর্শ বড়ো উদ্দেশ্য আছে তার কথা যেন আমরা বিস্মৃত না হই, এই মিলনের আদর্শকে যেন আমরা মনে জাগন্ধক রাখতে পারি। ৬ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪• { ঐনিকেতনের বার্ষিক উৎসবে কথিত অভিভাষণের অমুলিপি },