পাতা:প্রবাসী (ঊনচত্বারিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৭১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নবযুগের কাব্য ঐরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উনিশ খ্ৰীস্টশতকে আধুনিক কালের পাঠশালায় আমরা পাশ্চাত্য সাহিত্যের যখন চেহারা দেখলুম তখন দেখা গেল তার রাস্তা পাকা ক’রে বাধানো। সকল দেশের দিকে সে খোলা । সে পথে আমাদের মনের চলাফেরা বাধা পেল না । যে সকল আনন্দতীর্থের দিকে তার নির্দেশ ছিল আমরা সহজেই তাকে আয়ত্ত করতে পেরেছিলুম। বড়ো বড়ো তীর্থযাত্রী যারা এই পথকে প্রশস্ত করতে করতে চলে গিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় অন্তরঙ্গ হয়েছিল । অবশেষে এমন বিপর্যয় যে হঠাৎ আসতে পারে যাতে করে সেই বিশ্বপথ ও যানবাহনের পরিবতনে আমরা একটা অপরিচয়ের দুর্গমে এসে পড়ব তা মনে করতে পারি নি। কিন্তু সেই সনাতনী সীমানার মধ্যে মাঝে মাঝে আবহাওয়ার বদল যে লক্ষ্য করিনি তা নয়। ইংরেজি সাহিত্যে আলেকজাণ্ডার পোপ যে-ঋতুর বাহন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ সে-ঋতুর নন। এই বদল মনেরই বদলের অম্বুবতী। প্রাকৃত জগৎ এবং মানস জগৎকে দুই যুগের কবিরা ভিন্ন চেহারায় দেখেছেন তাই ছন্দ ও ভাষা আপনিই বদলিয়েছে তার প্রকাশভঙ্গী। আমরা সেই অধুনাউপহসিত ভিক্টোরীয় যুগের সাহিত্যের দান গ্রহণ করেছি, দীক্ষা পেয়েছি তারই কাছ থেকে। সেই অনুসারে যা মুন্দর যা মহৎ তাকে সন্ধান করেছি বিশেষ ভাবে বিশেষ স্থানে, বিশেষ অনুষ্ঠানে তার জন্যে আসন পেতেছি । এমন সময় যুরোপে প্রকাও এক যুদ্ধে মন্ত একটা সামাজিক ভূমিকম্প ঘটল। বিশ্বের সঙ্গে মানুষের ব্যবহারের ভূমিকা যেন বদলে গেল। রূঢ় হ’ল ভাষা, যে সকল আবরণের দ্বারা আচরণের প্রসাধন করা হ’ত তার সম্বন্ধে একটা অসহিষ্ণুতা দেখা দিল । আজ পর্যস্ত প্রসাধনের দ্বারা মাচুৰ্য আপনার একটা পরিচয় নিজের চেষ্টায় রচনা করে এসেছে। নিজের নগ্নতার উপরে পরিয়েছে শিল্পের উত্তরীয়। অর্থাৎ মাহুষের যে স্বরূপ প্রকৃতিদত্ত, তার উপরে সে স্থাপন করেছে নিজের রচনা। সে ষা ইচ্ছা করে, সেটাকেও করেছে আপন প্রকাশের অঙ্গ। মানুষ স্বয়ং কী এবং মাস্থ্য কী চায় এই দুইয়ে মিল করিয়ে তবেই মানুষ আপনাকে সম্পূর্ণ ব’লে জেনেছে ও জানিয়েছে। এই জন্থেই ইতিহাসে র্যারা মহাপুরুষ বলে গণ্য তারা কিছু পরিমাণে ঐতিহাসিক, আর অনেক পরিমাণে আমাদের ভাবের স্বষ্টি। পূজা করবার একান্ত প্রয়োজন আছে মামুষের, সেই প্রয়োজন ব্যস্ত হয়ে রয়েছে আপন শিল্প-উপকরণ নিয়ে । ভক্তিক্ষুধাতুর মানুষ ইতিহাসের বাস্তব মূর্তির উপরে রং চড়িয়ে আপনাকে তুলিয়ে কত অনৈসর্গিক প্রতিমা বানাচ্ছে তার সংখ্যা নেই। শুধু পূজা করা নয়, রস-উপভোগের আকাঙ্ক্ষা মানুষের প্রবল। তাই তার উপভোগের বিষয়কে সে দোষমুক্ত মুসংগতি দিয়ে রুচির অমুকুল করতে চায়। যে অল্প তার প্রাণরক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক, তাকে কেবলমাত্র আপন ক্ষুধা মেটাবার তাগিদে পশুর মতো যেমন তেমন করে মানুষ খেতে পারে না। ষে-ক্ষুধা প্রকৃতিদত্ত তার আশুনিবৃত্তি সংবরণ করে মানুষ তার উপরে স্বরচিত শিল্পের শোভনতা বিস্তার করে। অল্পের সামনে নিজেকে একাস্ত ক্ষুধিত বলে চাঞ্চল্য প্রকাশ করলে তার সম্পূর্ণ উপভোগের ব্যাঘাত ঘটে। মাহুষের আদিম প্রবৃত্তির উপকরণকে অপরূপতা দেবার জন্তে ভিন্ন ভিন্ন জাতির মামুযের মধ্যে উপভোগের ষে আবরণ স্বাক্ট হয়েছে তারই শ্রেষ্ঠত বিচার ক’রে তার স্বাঞ্জাতিক সংস্কৃতির উৎকর্ষ বিচার হয়ে থাকে। যৌনবৃত্তি মানুষের একটি আদিম প্রবল প্রবৃত্তি সন্দেহ নেই, কিন্তু যে মানুষ সেই বৃত্তিকে দৈহিক ক্ষুধা মেটাবার ঐকাস্তিক অসংযত পথে চালনা করে সে নিন্দনীয় হয় কেবল নীতির আদর্শ থেকে