পাতা:প্রবাসী (চতুর্দশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

☾b← জামরা পরদিন উদিপুর গ্রামের পাস্তাবাসের জন্য নির্ণীত স্থানে যখন পৌছলুম, সেখান থেকেও রামগড় গিরি চার মাইল দূরে স্থিত। শুনলুম, আমাদের উদিপুরেই তাঁবুতে বাস করতে হবে; কেন না, রামগড় পাহাড়টি এত অরণ্যময় এবং হিস্ৰজন্তুসংকুল যে সেখানে শিবিরাবাসে থাকা কোন মতেই নিরাপদ নয় । একটা বিশাল শাখাপ্রশাখাপ্রসারিত অতি প্রাট মথথ গাছের নীচে আমাদের ভাবু পড়ল । আমরা সেদিনকার মত বিশ্রাম নিলুম । গিরি-কাহিনী রামগড় পাহাড়টি তার পাদদেশ থেকে দু হাজার ফুট উচু। সেই পাহাড়ের মাথায় একটা অতি প্রাচীন জীর্ণকঙ্কাল মন্দির শৈলরাজের ভগ্ন কিরীটের মত র্তার কোন স্বরণাতীত যুগের গৌরবের সাক্ষ্য দেবার জন্তেই যেন সেখানে বিরাজ করচে! আমরা প্রথমেই সেই মন্দিরটি দেখতে গেলুম। গঙ্গপৃষ্ঠে সমতল ভূমি এবং অরণ্যের কিয়ৎ অংশ পার হয়ে, পরে পদব্রজে প্রথমে খুব চড়াই পাহাড় কতকটা দূর উঠলুম ;–শেষে, একটা উচু উপত্যকায় এসে পড়লুম। এই উপত্যকাটি অতিক্রম করে সৰ্ব্বোচ্চ পাহাড়ে মন্দিরে যেতে হয়। সৰ্ব্বোচ্চ পাহাড়টির গায়ে ঠিক নীচেই ঐ উপত্যকার একটা ঝরণা ও কুণ্ড আছে। প্রবাদ এই যে এইখানে নাকি সীতাদেবী বনবাসের সময় রাম লক্ষণ সমভিব্যাহারে স্বান করেছিলেন । এই স্থানে যথন মেলা হয় তখন তীর্থযাত্রীরা এই ধারাকে অতি পবিত্র ভাগীরথীর চেয়েও পুণ্যপ্রদ বলে মনে করে। আমরা সেখানে কিছুকাল বিশ্রামের পর ক্রমে উচু পাহাড়টিতে উঠতে লাগলুম। পথিমধ্যে একটা প্রবেশদ্বারের পাথরের ভগ্নাবশেষ পেলুম, তার কারুকার্য্য কালের করাল গ্রাসে একেবারে অন্তৰ্হিতপ্রায় –পূৰ্ব্বগৌরবের পরিচয়টুকু অতিকষ্টে আবিষ্কার করা যায়। সেটা অতিক্রম করে কিছুদূর অগ্রসর হলে কতকগুলি পাথরের খোদাই কর। সতীস্তম্ভের মত স্তন্ত ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে দেখলুম। এগুলিও এত ক্ষয়প্রাপ্ত যে তার বিশেয কিছু নির্ণয় করা গেল না। পথের ধারে আর একস্থানে একটা উচ্চ পাথরের বেদীর মত, তার উপরে ওঠবার সিড়ির ধাপ তার গায়েই কেটে তৈরী প্রবুলীি—কাৰ্ত্তিক ১৩২১ • [ ১৪শ ভাগ, ২য় খণ্ড করা। এগুলির তাৎপর্য্য যে কি তা সহজে ধরা যায় না। তার আরও খানিকটা দুরে আবার একটা ছোট্ট নকলমন্দির একটা ক্ষুদ্র পাথরের স্তুপ কেটে তৈরী –এটা যেন তীর্থযাত্রীদের আশাপথের একমাত্র ভরসার মত বিরাজ করচে । এক জায়গায় পথের ধারে একটি নাতিবৃহৎ চৌকো পাথরের গুহার মধ্যেটা ফঁাপা আর তাতে মধ্যে প্রবেশ করবার জন্তে ক্ষুদ্র দ্বার কেটে তৈরী করা। গুহ এবং দ্বারটি এত ছোট যে শিশু ছাড়া কেউই প্রবেশ করতে পারে না । এইবারে আমাদের দুরারোহ খাড়াই পাহাড়ের আরও উচ্চ শিখরে উঠতে হল। বন্ধুবর সমরেন্দ্রনাথের শরীর অসুস্থ থাকায় তিনি নিরস্ত হলেন । আমাদের সাথী প্রত্নতত্ত্ববিভাগের মিষ্টার ব্ল্যাকিষ্টন তার সহকারী শ্ৰীযুক্ত নরেন্দ্রনাথ বসুকে নিয়ে আমার সঙ্গে যোগ দিলেন । কোন গতিকে পাহাড়ের উপরে ওঠবার একটিমাত্র পথ তীর্থযাত্রীদের পায়ে পায়ে তৈরী হয়েচে । অবলম্বনের মধ্যে সামনের পাহাড়ের গায়ের পাথর ছাড়া আর কিছুই নেই। আমি যে কি করে এবং কি সাহসে ঐ পাহাড়ের উপরে উঠেছিলুম যখন নেবে এসে নীচে থেকে উৰ্দ্ধে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলুম তখন তা ভেবেই স্থির করতে পারিনি ! অনেকক্ষণ ক্রমাগত সীস্বপের মত পাহাড়ে উঠে যখন একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েচি, তখন সহসা একটা পাথরের চমৎকার কারুকার্য্যথচিত তোরণ দ্বার সম্মুথে দেখতে পেয়ে যে কি আনন্দ হল তা লিখে ব্যক্ত করা যায় না ! আবার যথন সেই দ্বারের সিড়ি বেয়ে উঠে একটা বেশ পরিচ্ছন্ন পাথরের প্রাচীর ঘেরা মঞ্চস্থলের উপর এসে পড়লুম তখন সেখান থেকে দুরের নীচের শৈল-সৌন্দর্য্য যেন স্বপ্নলোকের মধ্যে আমাদের নিয়ে গেল ! এই স্বপ্ন-কুহেলি-মাখা বিরাট ধরার গুমিল কোলটি যে কি অপরূপ ও অনিৰ্ব্বচনীয় তা সেখান থেকে য। উপভোগ করেছিলুম, আমরণ আমার মনে জাগরূক থাকৃবে। আমাদের দৃষ্টিপথে দিকচক্রবালের সীমান্তের তরঙ্গায়িত সুনীল পৰ্ব্বতশ্রেণী যেন নীল বিশ্বকমলের দলের মত সহসা বিকশিত হয়ে উঠল!--সে দিক থেকে চোখ ফেরাতে আর মন চায় না।