পাতা:প্রবাসী (চতুর্বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৪১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৭৬ প্রবাসী—জাষাঢ়, ১৩৩১ [ ২৪শ ভাগ, ১ম খণ্ড “তোমার ঠাকুর্দাদা থেকে আরম্ভ করে’ উৰ্দ্ধতন জার কেউ কখনও চা স্পর্শ পৰ্য্যস্ত করেননি, অথচ ঠাওীও যে আমার চেয়ে তাদের কম ভোগ করতে হয়েছিল তা নয় ! দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অভিযোগ, এ-সব আমার নিজেই তৈরী করেছি। আমাদের পূর্বপুরুষেরা ষে জিনিসের নাম পৰ্য্যন্ত জানতেন না, আমাদের সেই জিনিসের নেশা হ’য়ে দাড়িয়েছে । তোমার ব্ৰজ-কাকা যে বলেন, সকালে উঠে কাকেরা কা কা করে’ ডাকে আর চা-খোরেরা চা চা করে’ চেচায়, সে কথা ঠিক।” বলিয়া প্রমদাচরণ হাসিতে লাগিলেন । সম্মুখের একটা চেয়ারে ধীরে-ধীরে বসিয়া পড়িয়া স্থমিত্রা বলিল, “কিন্তু বাবা, পূৰ্ব্বপুরুষদের সময়ে জীবন-ধারা অনেক সহজ ছিল, তাই অনেক জিনিসের দরকারই তাদের হত না । তখন দেশ-বিদেশের সঙ্গে এমন অবাধ কারবার ছিল না, তাই আমূদ্রানিও ছিল না, রপ্তানিও ছিল না, দেশের জিনিস-পত্রেই দেশের অভাব মেটাতে হত : এখন পৃথিবীর সমস্ত দেশের সভ্যতার সঙ্গে আমাদের কারবার চলেছে, তাই আমাদের নতুন জীবন-ধারার পক্ষে হয়ত আগেকার অনেক জিনিস অনুপযোগী আর এখনকার অনেক জিনিস উপযোগী হয়ে পড়েছে।” - গল হইতে পশষ্ট্র গলাবন্ধটা তাড়াতাড়ি খুলিয়া ফেলিয়া চেয়ারের উপর সোজা হইয়া বসিয়া প্রমদাচরণ বলিলেন, “ত হয়ত হয়েছে, কিন্তু যতটা না বাস্তবিক হয়েছে তার শত গুণ হয়েছে মনে করে আমরা আমাদের উৎপীড়িত করে তুলেছি। যে-দেশে ঘরে ঘরে নেবুর গাছ আর দই-চিনি মজুত, সে-দেশে বিলাতী লাইম্স্কুল কর্ডিয়ালেরই বা कि गद्दीब, আর যে-দেশে গাছে গাছে ভগবান সর্বতের ভাড় ফলিয়ে রেখেছেন সে-দেশে সোডালেমনেড়েই বা কি হবে ? তুমি অন্ত দেশের সভ্যতার কথা বলছিলে, কিন্তু আমার মনে হয় জমিত্র, বিদেশী সভ্যতাকে একেবারে এড়িয়ে যাওয়াও বরং ভাল, কিন্তু তার মধ্যে একেবারে তলিয়ে যাওয়া ভাল নয়। আধুনিক সভ্যতার জাদশ-ক্ষেত্র হচ্ছে আমেরিকা, কিন্তু সেখানকার লোকের অবস্থা জান ? তারা অতি-সভ্যতার চাপে এমন অস্থির হয়ে উঠেছে যে, প্রতিবৎসরই তাদের মধ্যে খুন আর আত্মহত্যার সংখ্যা ভয়ানকরকম বেড়ে উঠছে। সে-সভ্যতা যদি আজ ষোল-আনা আমাদের দেশে এসে হাজির হয়, তা হ’লে যারা আজ মোটর-গাড়ী চড়ে’ গড়ের মাঠে হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে, তাদের অধিকাংশকেই মোটর-গাড়ী তৈরী করবার জন্তে কারখানায় ঢুকতে হবে। আর তা না হ’য়ে যদি আরও অনেক বেশী লোক মোটর-গাড়ী চড়তে আরম্ভ করে, তা হ’লেই যে দেশের মোট স্বথ বেড়ে যাবে তা মনে কোরো না। কলকারখান-বাড়ার সঙ্গে যে জিনিসটা বাড়ে সেইটেই সভ্যতা নয়। যন্ত্রের সঙ্গে যন্ত্রণাও বাড়তে থাকে ৷” বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া সুমিত্রা প্রমদাচরণের কথা শুনিতেছিল। প্রমদাচরণের মধ্যে প্রকৃতিগত বিদেশপ্রিয়তা কখনও ছিল না ; কিন্তু ষ্টীমলঞ্চ যেমন নিজের পথে গাধা-বোটকে টানিয়া লইয়া যায় ঠিক সেইরূপে শক্তি-শালিনী জয়ন্তী নির্বিরোধী প্রমদাচরণকে সারা-জীবন নিজের অভিমতে টানিয়া আসিয়াছেন , তাই বাধ্য হইয়া প্রমদাচরণকে খানাও খাইতে হইয়াছে, ড্রেসিং গাউনও পরিতে হইয়াছে এবং গ্রীষ্মকালের রাত্রেও স্লীপিং স্কটের মধ্যে নিদ্রা যাইতে হইয়াছে। জয়ন্তীর অজ্ঞতা এবং অক্ষমতাই যদি না রক্ষা করিত তাহা হইলে সম্ভবতঃ তাহাকে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সহিত ইংরেজীতে কথাবাৰ্ত্ত কহিতে হইত। ' প্রমদাচরণের এই বিদেশী আবরণ ও আচরণের সহিত র্তাহার নিজের অস্তরের বিশেষ কোনও যোগ ছিল না, সে-কথা জানা থাকিলেও ঠিক এমনভাবে প্রমদাচরণকে আত্মপ্রকাশ করিতে স্বমিত্রা কখনও দেখে নাই। তাই সে তাহার পিতার এই নূতনধরণের কথা উত্তরে কি বলিবে মনে-মনে ভাবিতেছিল, এমন সময়ে প্রমদাচরণের সম্মুখস্থ সংবাদপত্রে লালরেখাবৃত অংশে সহসা তাহার দৃষ্টি পড়িয়া গেল।