পাতা:প্রবাসী (চতুর্বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৪৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8&b [ ২৪শ ভাগ, ১ম খণ্ড ভাল করে দিয়ে উঠতে পারেনি। কেউ কেউ বলেছেন যে আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে আমরা আমাদের ক্রমশঃ পূর্ণতরভাবে বিকাশ করব, কিন্তু সে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে কেন আমাদের পূর্ণতরভাবে বিকাশ করা আমাদের উদ্দেশু হবে ? শুধু প্রেয়ই কেন আমাদের চরম উপেন্ন হবে না ? আমার জবাব হচ্ছে এই যে, শ্রেয় ও প্রেয় এই দুই নিয়েই আমাদের জীবন, এই দুয়েরই কেহই কম সত্য নয় । এই দুইকেই ভর করে আমাদের চলতে হবে। এই দুইয়ের মধ্যে কিন্তু এমন একটা অচিন্ত্য সম্বন্ধ আছে যে, একের মধ্যে অপরের আমরা সাক্ষাৎ পেতে পারি। যে মনীষীরা আমাদের দেশে শুধু শ্রেয়ের অন্বেষণে সমস্ত জীবন পণ করে দৃঢ়ব্ৰত হ’য়ে নিষ্ঠাপর হয়ে ছুটেছিলেন, তাদের কাছে শ্ৰেয়ই প্রেয় হয়ে উঠেছিল। শ্রেয় শুধু তাদের শ্ৰেয়রূপে আকর্ষণ করেনি। শ্রেয়ট তাদের কাছে যথার্থই প্রেয় হ’য়ে উঠেছিল। নইলে তার আকর্ষণে এত জোর হবে কেমন করে । আবার যারা প্রেয়ের পথে চলেছে, সে পথেও “জীবহিত” “বিশ্বহিত” “দেশের কল্যাণ” ইত্যাদি নানা মূৰ্ত্তিতে শ্রেয় তাদের সামনে আবির্ভূত হয়েছেন। শ্রেয়কে ছেড়েও প্রেয় নেই, প্রেয়কে ছেড়েও শ্রেয় নেই। উপনিষদ যে শ্রেয় ও প্রেয়ের বিরোধের কথা বলেছেন, সেটা আমার কাছে ক্ষণিক বিরোধ ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। মানুষ কিছুক্ষণ শুধু প্রেয়েরই বশ হয়ে কাজ করতে পারে এবং তাতে শ্রেয়ের আহবান কানে না তুলতে পারে,আবার তেমনি আপাততঃ মনে হ’তে পারে কেউ বা যেন শ্রেয়ের বা কৰ্ত্তব্য একটা আদর্শের গভীর আকর্ষণে পথ চলতে পারে, কিন্তু আমার মতে এমন ব্যাপরটা বেশী কাল চলতে পারে না ; প্রেমের পথে যে চলেছে কিছুদূর চলতে না চলতেই শ্ৰেয়ের দাবীতে তার মন ভারী হয়ে আসবে এবং প্রেয়ের আসনে শ্রেয়কে প্রতিষ্ঠিত না করে” সে কখনো প্রেমের মধ্যে তার প্রিয়কে যথার্থভাবে পাবে না । এবিষয়ে শ্রেয়ের একটা বিশেষত্ব এই যে শ্রেয়ের পথে চলতে গেলে প্রেয়কে পাবেই পাবে, কারণ যার আকর্ষণে সে চলেছে সেটা তার কাছে প্রিয় না হ’য়ে পারে না। কাজেই প্রেয়ের মধ্যে প্রেয় রয়েছেই। শুধু প্রেয়ের পথে শ্রেয়ের বিচ্যুতি ঘটতে পারে, কিন্তু সেই বা কতক্ষণ, প্রেয়ের পথে শ্রেয়কে না এনে আমরা পারিনে। যার যা দাবী তাকে তা না দিলে আমাদের জীবন চলতেই পারে না। একটা কথা এখনও রয়ে গেল, সেটা হচ্ছে এই যে এমন মনে হ’তে পারে যে আমি কোন কথা বলতে কোন কথা বলতে আরম্ভ করলুম। আমি আরম্ভ করেছিলুম সমুদ্রের কথা দিয়ে ; বলেছিলুম সাগরের নীল জলের দিকে চেয়ে আত্মহারা মনেহার হয়ে কোথায় যেন তলিয়ে যাই তার ঠিকানা থাকে না, তার সঙ্গে শ্রেয় ও প্রেয়ের দ্বন্দ্ব কোনখানে ? পূর্বে যে কথা বলছিলুম সেটা হচ্ছে মনস্তত্ত্বের কথা (psychological) আর অপরটি হচ্ছে কৰ্ম্মপথের আদশের কথা ( othical ) । একটার থেকে আর-একটায় আমি কেমন করে ঝাপিয়ে এলুম ? এর জবাবে আমার এই কথা মনে হয় যে, এ দুইয়েরই আসল কথা আমার কাছে একই বলে’ মনে হয় । প্রেয়ের রাজ্যে হচ্ছে সেইখানে যেখানে আমরা লাভলোকসানের জমাখরচ রীতিমত খতিয়ে উগুল দিয়ে আমাদের নিজ নিজ তহুবীল রীতিমত মিলিয়ে নিতে পারি। এই তহবিল-মিলানর কাজ যুক্তি-বিচারের কাজ । এতে দেনা-পাওনা আছে, হিসাবনিকাশ আছে, বোঝাপড়া আছে ; এটা হচ্ছে মনের নিজের রাজ্য, তার ঘরকরণার ব্যাপার । কিন্তু আদর্শের দিকৃটা মনেব বাইরে । সেট যেন মনোহরণপুরের কথা—গহনং গভীরং । আমার মুখ ছেড়ে দেশের স্বখ কেন দেখ ব এপ্রশ্নের জবাব খতিয়ে তোলা যায় না । যুক্তি এখানে মুক । এটা হচ্ছে একটা গহন গভীর পুরীর ডাক, যেখানে মন থই পায় না, তার বিচার সেখানে নাগাল পায় না । মনে পাইনে বলেই এর দাবী নেই বলা চলে না । কারণ মনই আমাদের সর্বস্ব নয়। আমরা মনেও আছি, মনোলয়েও আছি । মন দিয়ে মনোলয়কে মাপা যায় না, আবার মনোলয় দিয়ে মনকে মাপা যায় না । এই যে উভয়ের মিলন ও দ্বন্দ্ব এইখানেই জীবনের হেঁয়ালী। চিস্তার লয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা যে মনোহরণের আবেশে আপনহারা হয়ে অরূপের সাক্ষাৎ পাই তারই রূপ আমরা আমাদের কৰ্ম্মযাত্রার আদশের মধ্যে সাক্ষাৎ করি । আদর্শের রূপ এই গহন গভীরেরই রূপ। মনস্তত্বের দিকৃ দিয়ে যেটা মনোহরণের উপলব্ধি, কৰ্ম্মযোগের পথে সেইটিই হচ্ছে আদশের উপলব্ধি । Psychological এবং ethical এই দুই দিকের মধ্যে যে, একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, তা আমাদের দেশের মনীষীরা বহুদিন থেকেই ধরেছিলেন। সেইজন্ত যোগ-শাস্ত্রে চিত্তকে ত্যাগমুখী করবার একটা প্রধান উপায়ই হচ্ছে শকে কোনো এক জায়গায় বেঁধে তাকে হারিয়ে ফেল্বার চেষ্টা করা, চিত্তবৃত্তি নিরোধ করা। চিত্তবৃত্তি নিরোধ করুবার অভ্যাস করলে খালি যখন চিত্ত নিরুদ্ধ থাকে তখনই-চিত্তের একটা সার্থকতা হ’ল তা নয়। নিরোধের পর চিত্ত যখন জেগে ওঠে তখনও তার ফল পাওয়া যায় । নিরোধের অভ্যাসের ফলে, সজাগ অবস্থাতেও মন পাতলা হয়, মনের কলুষতা দূরে যায়, মনের শক্তি বাড়ে এবং বিষয়-ভোগের মধ্যেই মন তাকে একেবারে নিঃশেষ করে ফেলতে চায় না, সে মনে করে ষে ভোগই তার পরমার্থ নয়, ভোগে আসক্তিই তার চরম উপেক্ষ নয়.