পাতা:প্রবাসী (চতুস্ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৩৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পৌষ৬ দৃষ্টি-প্রদীপ 8SS মালতী খুব ছুটোছুটি করতে পারে বটে, কিন্তু ওর গায়ে তেমন শক্তি নেই। নীরদার সাহায্য না পেলে সেদিন শুধু মালতীকে নিয়ে মড়া নামানো সম্ভব হ’ত বলে মনে হয় না । শেষপর্য্যস্ত গায়ের লোক এল এবং তারাই মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে গেল । আমিও সঙ্গে গেলুম, মেয়েদের যেতে হ’ল না, মালতী রইল নীরদার কাছে । নীরদ আমায় বললে—দাদা, শ্রীদ্ধের সময় কিন্তু আপনাকে সব ভার নিতে হবে । আর কারও হাতে দিয়ে আমার বিশ্বাস হবে না । রুণি ত আছেই, আপনাকে অঙ্গ কিছু থাটাবো ন}, ভাড়ারের ভার আপনাকে হাতে নিতে হবে, নইলে এ-সব পাড়াগায়ের ব্যাপার আপনি জানেন না । বেশ ঘটা ক’রেই শ্রাদ্ধ হ’ল । মালতী পৃক দিয়ে পড়ে কি খাটুনিটাই খালে ! মালতী তুমি আমার চোখ খুলে দিলে । ঘুম নেই, লাওয়া নেই, খাওয়া নেই, বসা নেহ— কিসে কাজ সৰ্ব্বাঙ্গসুন্দর হবে, কেউ নিন্দে করবে না ওদের, কোন জিনির অপচয় না হয় ওদের, সে-ই একমাত্র লক্ষ । পরের কাজে এমনি ক’রে নিজেকে ঢেলে দিতে তুমি পার তোমার বাবার রক্ত তোমার গারে বইছে বলে। নীরদাকেও চিনলুম সেদিন । রাত দশটা ৷ রান্নাঘরের দরজার কাছে শুষ্ঠ ডালের গামল, লুচির ধামা, ডালুনার বালতির মধ্যে নীরদ দাড়িয়ে ছে। সারাদিন কি খাটুনি থেটেছে সে । চরকীর পাক ঘুরেছে মালতীর সঙ্গে সমানে সেই সকাল থেকে—এর মধ্যে আবার পীড়িত মায়ের দেখাশুনা করেছে ওপরে গিয়ে। ঘামে ও শ্রমে মুখ রাঙা, ( নীরদার রং বেশ ফস1) চুল আলুথালু হয়ে মুখের পাশে কপালে পড়েছে। আমি বাইরের ক-জন লোককে থাওয়াব ব’লে কি আছে না-আছে দেখতে রান্নাঘরে ঢুকেছি। নীরদ বললে— দাদা, কিছু নেই আর । ক-জন লোক ? আচ্ছা দাড়ান, ময়দ মাখছি, দিচ্ছি ভেজে । আমি বললুম—আর তুমি আগুনের তাতে যেও না নীরদ । তোমার চেহারা যা হয়েছে । আচ্ছা দাড়াও— মালতীকে বলি একটু মিছরির সরবৎ তোমায় বরং দিয়ে— নীরদ বললে—ড়িান, ধাড়ান দাদা । ক্ষণি কক্তবীয় খাওয়াতে এসেছিল—যে কি চুপ করে থাকবার মেয়ে ? তার পর হেসে বললে—আজি যে একাদশী, দাদা । আমার চোখে জল এল। আর কিছু বললাম না । মেয়েমান্বঘের মত সহ করতে পারে কোন জাত ? অনেক শিখলাম এদের কাছে এই ক-মাসে । মাকে দেখেছি, বৌদিদিকে দেখেছি, সীতাকে দেখেছি, শৈলfদকে দেখেছি, এদেরও দেখলাম ! অথচ এই নীরদকে ভেবেছিলুম অশিক্ষিতা গ্রাম্য মেয়ে, ওর কথাবাৰ্ত্তায় রাঢ় দেশের টান বড় বেশী ব’লে । মালতী আখড়ায় ফিরে এসে আমায় বললে—অনেকগুলো সন্দেশ এনেছি, খান—নীরদ-দিদি জোর ক’রে দিলে । ভাল সন্দেশ, দ্বারবাসিনীতে এ-রকম করতে পারে না, শিউড়ি থেকে আনানো । তার পর কেমন এক ধরণের ভঙ্গি ক’রে হাসতে হাসতে বললে—বমুন, ঠাই ক’রে দিই আপনাকে । ওবেলার লুচি আছে, দই আছে,—নীরদা-দিদি এক রশি খাবার দিয়েছে বেধে— ওকে এত ছেলেমানুষ মনে হয় এই-সব সময়ে ! ঘরে কেউ নেই, নিঃসঙ্কোচে আমার কাছে ব’সে ও আমায় খাওয়ালে—খেতে থেতে একবার ওর মুথের দিকে চাইলাম। কি অপূৰ্ব্ব স্নেহ-মমতামাখা দৃষ্টি ওর চোখে ! মালতীর কাছে এত ঘনিষ্ঠ যত্ব এই কিন্তু প্রথম । বললে— আমি কি আর দেখি নি যে আজ সরাদিন আপনি শুধু খেটেছেন আর পরিবেশন করেছেন, খাওয়া বা হয়েছিল ওবেলা আপনার, তার আমি সন্ধান রাখি নি ভেবেছেন ? খান,—না—ও লুচি ক-খান থেতেই হবে । থাবো কি, লুচি গলায় আটকে যেতে লাগল—সে কি অপূৰ্ব্ব উল্লাস, আমার সারাদেহে কিসের যেন শিহরণ। আজ সারাদিনের ভূতগত খাটুনির মধ্যেও মালতী দৃষ্টি রেখেছিল আমি কি থেয়েছি না-খেয়েছি তার ওপর । २ ঘন বর্ষ। নমিল। সারা মাঠ আঁধার ক’রে মেঘ ঝুপসি হয়ে উপুড় হয়ে আছে। এই-সব দিনে মালতীকে সৰ্ব্বদা পেতে ইচ্ছা করে—ইচ্ছে করে ঘরের কোণে বলে ওর সঙ্গে সারা দিনমান বাজে বঞ্চি । কিন্তু ও মাসে না, এমনই সব বর্ষার দিনে আখড়াৱ যত সব খুচরে কাজে ও ব্যস্ত থাকে।