পাতা:প্রবাসী (চতুস্ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জীবিকা ক্রমাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় কালুর বাবা মাধব দাস দিনমজুরী করিয়া জীবিকা অর্জন করিত। লোকে তাহাকে ভাড়া লহঁত দিনহিসাবে। মফস্বলে ঘণ্টা ধরিয়া সময়ের হিসাব নাই । ঘড়ি ক’জনেই বা রাখে ! দিন যাহার আদি-অন্তহীন কীৰ্ত্তি সময়ের হিসাব করিতে মফস্বলের লোক কাজে লাগায় তাহাকেই। এই নিয়ম স্থির করা আছে। পূব দিকের গাছপালার মাঝামাঝি স্বর্য উঠিয়া আসিলে মজুর কাজে লাগিবে, আর পশ্চিমের গাছগুলির আড়ালে গেলে পাইবে ছুটি । ঘড়ির কাটা নয়, তরুছায়ার আবর্তন, পশ্চিম হইতে পূবে । মাঝখানে দুপুরবেলা খাওয়ার জন্ত কিছু ক্ষণের ছুটি । তা ছাড়া, কাজের ফঁাকে ফাঁকে মজুর যদি পাঁচ মিনিট গাছের ছায়ায় বসিয়া তাহার কালে কলিকাটিতে তামাক টানিতে চায়, কারও কিছু বলিবার নাই। এ-কথা কে না জানে যে, মানুষ যন্ত্র নয়, মাঝে মাঝে সধুম দম টানার আরাম না পাইলে মন্ত্য খাটিতে পারে না ? মাধব কিন্তু চালাকি করিয়া পাওয়ার ছুটি ও তামাক টানার বিরাম ছাড়াও সুযোগমত ফাকি দিয়া আলস্য ভোগ করিয়া লইত । হয়ত সে বৈশাখী দ্বিপ্রহর । ঘর ছাইতে ছাইতে চালার উপরেই দারুণ রোদে পিঠ দিয়া খানিকক্ষণ হাত পা শিথিল করিয়া বসিয়া থাকিতে সে আরাম বোধ করিত কিনা সে-ই জানে, কিছু কিছু কঁকি না দিলে তাহার চলিত না । কাজের শে্য মজুরীরও শেষ । হাতের কাজ তাড়াতাড়ি শ্যে করিয়া যদি দুটি দিনও ঘরে বসিয়া থাকিতে হয়, দিনমজুরের সে অপূরণীয় ক্ষতি। মাধবের কাজ ছিল রকমারি। সে ঘর ছাইত, বেড়া বাধিত, কাঠ চেলাইত এবং এমনি আরও অনেক কিছু করিত। অল্প বয়সে কালুও এইসব কাজ শিখিতেছিল। কিন্তু হারাণের ছেলে মধুত্ব পাল্লায় পড়িয়া শেষ পর্যন্ত তাহার জীবিকা অর্জনের পথটা দাড়াইয়া গেল অষ্ট প্রকার। হারাণ কুল খুড়িত আর হারানো জিনিষের সন্ধানে ডুব দিত বিশ হাত জলের তলে । সে কায়মসলুর বয়স ছিল কম, পেটভরা ছিল প্লীহা আর মাথাভর বোকামি । মধুর সঙ্গে সে হারাণের জলে ডুবিবার প্রক্রিয়া দেখিতে যাইত। হারাণ জলের তলে অদৃশ্য হইয়া গেলে ছোট ছোট চোখ দুটি প্রাণপণে মেলিয়া মুখটু গ করিয়া ঢেউতোলা জলের দিকে একদৃষ্ঠে চাহিয়া থাকিত । কারও বারণ না মানিয়া এমন ভাবে কুয়ার মধ্যে ঝুঁকিয় পড়িত যে এক দিন বিপদ না ঘটিয়াই পারে নাই | সাতার কালু সেই বয়সেই মন জানিত না । কিন্তু কুড়ি বাইশ হাত নীচে জলের উপর আছড়াইয়া পড়িয়া বোধ হয় পেটের প্লীহাতেই অঘিাত লাগিয়া সে অজ্ঞান হইয়া গিয়াtছল । হারাণ নীচে না থাকিলে সে-দিন সে আর বাচিত না । শুধু হারাণের জলেডোবা দেখিতে নয়, কাছে হোক দূরে হোক সে কুপ-থনন আরম্ভ করিলে প্রতিদিন সেখানে হাজিরা না দিলে কালুর চলিত না । হারাণ ও তাহার সঙ্গীরা কোদাল দিয়া মাটি কাটিয়া তুলিত, কালু কৌতুহলের সঙ্গে চাহিয়া দেখিত। গৰ্ত্তটি কিছু গভীর হইলে ভিতরে নামিবার জন্য তাহার মন ছটফট করিত। কিন্তু অতটুকু ছেলের ব্যাকুলত কেহ বুঝিত না, নীচে তাহাকে কেহ নামিতেও দিত না । এককাকে সকলের চোখ এড়াইয় নামিয়া গেলেও পাতালের সেই কাম্য স্বর্গে কয়েক মুহূৰ্বের বেশী সে থাকিতে পাইত না, তাড়া থাইয়। উপরে উঠিয়া আসিতে হইত। কালুর কান্ন আসিত। তার পর বয়স বাড়িবার সঙ্গে বুকে কিছু সাহসের সঞ্চার হইলে জ্যোৎস্নারীত্রে এক সে বাহির হইয়া যাইত গ্রামান্তরে অৰ্দ্ধসমাপ্ত ইদারার উদ্দেশে । জ্যোৎস্নালোকে ইদারার ধারে দাড়াইয়া সে উত্তেজিত হইয়া উঠিত। খানিক তফাতে মাটির স্তুপ, ইদারার মধ্যে রহস্যঘন গভীর অন্ধকার, আর এই মনোতর স্বৰ্গ ও পাতালের কাছে এক সে উদ্‌গ্ৰীব বালক। যত ক্ষণ খুশী খেলা করুক, কেহ বারণ করিতে আসিবে না। কিন্তু খেলায় কালুর মন ছিল না, সে চুপ করিয়া দঁাড়াইয়