পাতা:প্রবাসী (চতুস্ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/১৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জ্যৈষ্ঠ হীরু তখন খাওয়া শেষ করেছিল। জ্যাঠাইমার গালাগালি গুমে মুখখান কাচুমাচু করে উঠে গেল । দাদা এ-সময় বাড়ি ছিল না—আমাদের মুখে এরপর শুনে বললে— আহা, ও পাগল, ছেলের শোকে পাগল হয়েছে । ও কি বলে ন-বলে তা কি ধরতে আছে ? ছিঃ, থাবার সময় জ্যাঠাইমার গালমন্দ করা ভাল হয়নি। আহা ! সীতা বললে, “গালাগাল দেওয়া ভাল হয়নি কেন, খুব ভাল হমেচে । খামোক বলবে যে বিয মিশিয়ে দিয়েচে ? লোকে কি মনে করবে ?” দাদা আর কিছু বললে না, চুপ করে রইল। সে কারুর সঙ্গে তর্ক করতে পারে না, সীতার সঙ্গে তো নয়ই। একবার কেবল আমায় জিগ্যেস করলে, “হীরুজ্যাঠা কোন দিকে গেল রে নিতু ?” আমি বললাম আমি জানিনে । এর মাস দুই তিন পরে, মাঘ মাসের শেষ, বিকেল বেলা । আমাদের ঘরের সামনে একটুখানি পড়ন্ত রোদে পিঠ দিয়ে স্কুলের অঙ্ক কষচি—এমন সময় দেখি হীরুঠাকুরকে সস্তপণে আস্তে আস্তে ধরে নিয়ে আসছে দাদা । ইক্লিঠাকুরের চেহারা শীর্ণ, মাথার চুল আরও উসকোখুসকো, মুখ প্যাঙাস্— জরে ধেমনি কাপচে, তেমনি কাস্চে । শুনলাম আজ না-কি চার-পাচ দিন অসুখ অবস্থায় আমাদেরই পাড়ায় ভটচাযিদের পূজোর দালানে শুয়েছিল । অমুখে কাশথুথু ফেলে ঘর অপরিস্কার করে দেখে তারা এই অবস্থায় বলেচে সেখানে জায়গা হবে না। হীরুঠাকুর চলতে পারে না, যেমন দুর্বল, তেমনি জর আর সে কি ভয়ানক কাশি ! কোথায় যায়, তাই দাদা তাকে নিয়ে এসেচে জ্যাঠামশাহ্মদের বাড়ি । ভক্ষে আমার প্রাণ উড়ে গেল । দাদার কি এতটুকু বুদ্ধি দেননি ভগবান ! এটা কি নিজেদের বাড়ি যে এখানে যা খুশী করা চলবে ? কোন ভরসায় দাদা ওকে এখানে নিয়ে এল দ্যাথো তো ? ষা ভয় করেছি, তাই হ’ল । হীরুকে অসুখ গায়ে হাত ধ’রে বাড়িতে এনেচে দাদা, এ-কথা বিদ্যুদ্বেগে বাড়ির মধ্যে প্রচার হয়ে যেতেই আমার খুড়তুতো জ্যাঠতুতো ভাই বোনের সব মজা দেখতে বাইরের উঠোনে ছুটে এল, সেজকাক এলে বললেন—“না ন+–এখানে কে নিয়ে এল ওকে ? এখানে জায়গা কোথায় যে রাখা হবে ?” কিন্তু ততক্ষণ یاد میس- : দৃষ্টি-প্রদীপ *

$3

জ্যাঠামশাহ্মদের চণ্ডীমগুপের দাওয়ায় হীর গুয়ে ধুকচে, দাদা চণ্ডীমণ্ডপের পুরোনো সপট তাকে পেতে দিয়েচে । তখনি একটা ও-অবস্থার রোগীকে কোথায় বা সরানো যায় ? বাধ্য হয়ে তখনকার মত জায়গা দিতেই হ’ল । কিন্তু এর জন্যে কি অপমানটাই সহ করতে হ’ল দাদাকে। এই জন্তেই বলচি দিনট কখনো ভুলবো না । দাদাকে আমরা সবাই ভালবাসি, আমি সীতা দু-জনেই । আমরা জানি সে বোকা, তার বুদ্ধি নেই, সে এখনও আমাদের চেয়েও ছেলেমানুষ, সংসারের ভালমন্দ সে কিছু বোঝে না, তাকে বাচিয়ে আড়াল ক’রে বেড়িয়ে আমরা চলি । দাদাকে কেউ একটু বকুলে আমরা সহ করতে পারিনে, আর সেই দাদাকে বাড়ির মধ্যে ডেকে নিয়ে গিয়ে প্রথমে সেঞ্জকাকা আথালিপাথালি চড়চাপড় মারলেন। বললেন, “বুড়ে ধাড়ী কোথাকার, ওই ইপিকাশের রুগী বাড়ি নিয়ে এলে তুমি কার হুকুমে ? তোমার বাবার বাড়ি এটা ? এতটুকু জ্ঞান হয়নি তোমার ? সাহসও তো বলিহারি, জিগোস্না বাদ না কাউকে, একটা কঠিন রুগী বাড়ি নিম্নে এসে তুললে কোন সাহসে ? নবাব হমেচ না ধিঙ্গী হয়েচ ? না এটা তোমার চা-বাগান পেয়েচ ?” এর চেয়েও বেশী কষ্ট হ’ল যখন জ্যাঠাইম অনেক গালিগালাজের পর রোমাকে দাড়িয়ে হুকুম জারি করলেন, “যাও, রুগী ছুয়ে ঘরে দোরে উঠতে পাবে না, পুকুর থেকে গায়ের ওকোটমৃদ্ধ ভুবদিয়ে এস গিয়ে ।” মাঘ মাসের শীতের সন্ধ্য। আর সেই কন্‌কনে ঠাগু। পুকুরের জল—তার ওপর চা-বাগানের আমলের ওই ছেড়া গরম কোটটা ছাড়া দাদার গায়ে দেবার আর কিছু নেই, দাদা গামে দেবে কি নেয়ে উঠে ? সীতা ছুটে গিয়ে শুকৃনে কাপড় নিয়ে এসে পুকুরের ধারে দাড়িয়ে রইল। মাও এসে দাড়িয়ে ছিলেন, তিন ভালমামুষ, দাদাকে একটা কথাও বললেন না, কেবল ঠক্ ঠক্‌ ক’রে কাপতে কঁপিতে জল থেকে সে যখন উঠে এল, তখন নিজের হাতে গামছা দিয়ে তার মাথা মুছিয়ে দিলেন, সীতা শুকনো কাপড় এগিয়ে দিলে, আমি গায়ের কোটট খুলে পরতে দিলাম। রাত্রে মা সাৰু ক’রে দিলেন আমাদের ঘরের উকুনে—-দাদা গিয়ে হীরুঠাকুরকে খাইয়ে এল ।