পাতা:প্রবাসী (চতুস্ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/২১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জ্যৈষ্ঠ ঘুরচে । একট। নিরুদেশ অন্ধ গতি । ছুটচে আর তার সঙ্গে বোধ করি একটু ভুলচেও । আরও পরে দেখা গেল, ঐ চলন্ত পৃথিবীর বুকে অকস্মাৎ জেগে উঠেচে একটি মুখ । একটি মেয়ের মুখ । কবিপ্রসিদ্ধ উপমায় বলা যায়, পদ্মপত্রে ঢাকা সরোবরের মাঝখানে ফুটে উঠল কমলদল, যেন অরুণোদয়ে একটি মাত্র সদ্যফোট স্বৰ্য্যমুখীর নিঃশব্দ নিরাড়ম্বর প্রণতি । একটি মেয়ের মুখ। ডাগর ডাগর দুটি চোখ । চোখের তারা স্থির থাকলেও মনে হয় যেন ওর চাঞ্চল্য ঐ স্থৈৰ্য্য উপচে বেয়ে পড়চে । পাতলা দুটি ঠোঁট, লাল টুকটুকে । গাল দুটি ঈষৎ ভারি, ওর হাসিভরা মুখে সৰ্ব্বদাই টোল খেয়ে আছে । একমাথা ঝাকড়া ঝাকড়া কালো চুল, কান ঢেকে ঝুমকোর মত ঝুলচে । কেউ কেউ মনে করচেন, শুধু প্রেম করার জন্যেই বুঝি ওকে স্বষ্টি করা হয়েচে । সে-কথা এখনও ঠিক ক’রে বলতে পারচিনে ; তবে প্রেম করার বয়সে ওর প্রেমে হয়ত অনেকেই পড়বে,—সে-বয়সে পৌছুতে ওর ঢের দেরি । ওর গলায় ঐ যে ছোট্ট ভাজের রেখাটি দেখা যাচ্চে, বয়সকালে ওটি হয়ে উঠবে আশ্চৰ্য্য বস্তু ; তখন মনে হবে এই পেলব রেখাটির আদেশ সব চেয়ে কঠিন আর অনতিক্রম । ওর গায়ের রং চাপার মত হওয়াই উচিত । সত্যিই তাই ; চাপার মত নরম, মন্থণ, আলো-করা । ও যখন বড় হয়ে ত্রীড়ায় মুখ নেবে ঘুরিয়ে, তখন ওর গণ্ডে দেখা দেবে রক্তোঞ্ছাসের প্রাণব্যঞ্জনা । সেই জন্যেই ত ওর রং হয়েচে অত গৌর আর ও হয়েচে গৌরী। বিরল বিজন প্রান্তে ফুলের মত ছোট একটি মেয়ে অকারণ খেলায় সৰ্ব্বক্ষণ মত্ত, খলখলিয়ে হাসে, আপন মনে মাথা নাড়ে, চুলগুলো এসে পড়ে কনের ওপর, চোখের ওপর, আর সেই সঙ্গে ছুলে ওঠে সমগ্র পৃথিবীট। নিঝরিণীর মত ভর দুরন্ত চাঞ্চল্য, কুলের সীমানা পেরিয়ে দুর দিক্‌চক্রবালে তার আভাস যায় হারিয়ে । ওকে দেখে আমার মনটা খুণীতে ভরে উঠেচে । আমার ইচ্ছে করচে ওকে ডেকে ওর সঙ্গে দু-দও আলাপ করি । “ও খুকী, ও খুর্কী, শোনো ।” ও চোখ তুলে চাইলে । একটি মেয়ে ఉSసి “তোমার নাম কি খুকী ?” ভ্ৰকুট করে তাকিয়ে ও বললে “ধ্যেত, বলব না।” তার বলার ভঙ্গীট এই যে, নাম জিজ্ঞাসা করলেই যে বলতে হবে তার কোনো মানে নেই। “ও খুকী, শোনই না। তুমি কি খেল খেলচে ?” “বেশ করচি”—ব’লেই সে দিল ছুই । ও আমার সঙ্গে ভাব করতে চায় না । - এতক্ষণ ওই ছিল আলো করে, আর চারপাশে অন্ধকার, — কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এখন দেখা গেল ওর বিধবা মাসী বলচেন, “কোথায় ছুটে চললি ওরে হতভাগী মেয়ে ? তোমরা কি কেউ গৌরীকে একটুকুও শাসন করবে না ?...” তোমরা অর্থাৎ গৌরীর মা ও পিসি ঝঙ্কার দিয়ে উঠলেন, “মেয়েট গেল কোথায় ? আন তো ধরে—” গৌরী ততক্ষণে বৃদ্ধ ঠাকুরদাদার আশ্রয় নিয়েচে । প্রশ্ন করচে, “দাদু, তোমার মাথায় নোংরা কেন ? কালেকালো চুল তুলে দেবো ?” গৌরী বড়ই চঞ্চল, বড়ই অস্থির । ওর মা-পিসি-মাসীরা সৰ্ব্বক্ষণ ওকে নিয়েই ব্যস্ত । বাপও চিস্তিত,—“তাই তো মেয়েটা বড় হ’লে - ” বাড়িতে ছেলেমেয়ের অভাব নেই, কিন্তু তাদের সঙ্গে গৌরীর বনে না, বড়র শাসন মানতে চায় না, বরঞ্চ উণ্টে ও-ই কবৃতে যায় শাসন । যেমন দুরন্ত তেমনি অবাধ্য মেয়ে । দমামায়া যেন ওর মধ্যে স্থান পায় নি, স্বযোগ পেলেই ভাইবোনদের ধ’রে অকারণেই মারে । তবু সৰ্ব্বক্ষণই ও কৌতুকে ভরা। কেউ আছাড় খেছে পড়লে ও ওঠে খলখলিয়ে হেসে, যেন লোকের অাছাড় খাওয়া ওর হাসির খোরাক যোগান দেওয়ার জন্যেই। নোংরাম ওর বড় ঘেন্না । কারুর নাকে সর্দি ঝরতে দেখলে ওর গা বমি-বমি করে, তাই মলমূত্রের ত্রিসীমানা দিয়ে যামু না । মাসী পিসি রেগে আগুন হয়ে বলেন, “ওরে হতভাগি, মেয়ে হয়ে জন্মালি কেন ?” গৌরী উত্তর দেয়, “বেশ করেচি, খুব করেচি।” ওঁরা করেন জোর, মেয়ে দাড়ায় বেঁকে । মা মঙ্গলচণ্ডীর পায়ে গৌরীর মা প্ৰণতি জানান, “হে মা মঙ্গলচণ্ডী, মুখ তুলে চেয়ে, বয়সকালে মেমের বুদ্ধিগুদ্ধি শুধরে দিও।”