পাতা:প্রবাসী (ত্রয়স্ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৩৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভবিতব্যতা ঐইলা দেবী বিয়ে-বাড়ির আলোর মালার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আকাশে মেঘের মেলা সে দিনে । শ্বেতপদ্মের আলপনা-ক্টাক চন্দনকাঠের আসনে রক্তবসন বধু এক বসে ভাবছে—বাইরের কোলাহলে তার মন নেই,-– উদ্বিগ্ন নয়নে আকাশভর আধারের পানে চেয়ে কি সে ভাবছিল । দেশের পরিচিত নীড় থেকে অনভ্যস্ত নগরীর বদ্ধ বক্ষপুটে বিবাহোপলক্ষে প্রবেশ করে অবধি মুহিতার অস্বস্তির শেষ ছিল না । চারিদিকের অপরিচিতের মাঝে একমাত্র পরিচিত শুধু তার পিতা-- সে তার কাছেই ঘেঁষে থাকত। মাকে স্বহিতার মনে পড়ে না, কোন শিশুকালে তিনি তাকে ছেড়ে গেছেন । পিতার কাছেই পালিত সে। চন্দ্রনাথের বয়সের সঙ্গে শরীর ভেঙে আসায় তিনি বিষমূ-কৰ্ম্ম দেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন । তার পুত্র উমানাথ এখন জমিদারীর পরিচালনা করেন। উমানাথ অধিকাংশ সময় থাকেন কলকাতায়, ও থাকলেও মহাল পরিদর্শন থেকে মোকদ্দমার তদ্বির করা প্রভৃতি সমস্ত ভারই ছিল তার ওপর । চন্দ্রনাথ দেশকে ছাড়তে পারেন নি। মায়াপুরে বনেদী ধরণের বৃহৎ অট্টালিকা, পূর্বের জলুস নেই, পূর্বের আয়তন এখনও বজায় আছে। কয়েক জন আশ্রিত ও দাসী পরিচারক নিয়ে পিতাপুত্রীর এই গ্রামের বিজনে দিন কাটে । বিবাহের দু-দিন আগে মুহিতাকে নিয়ে চন্দ্রনাথ কলকাতায় এলেন। উমানাথই সব আয়োজন করেছিলেন, তিনিই কৰ্ম্মকৰ্ত্ত । কিন্তু চন্দ্রনাথের আসার পরদিনই উমানাথকে কলকাতা পরিত্যাগ করতে হ’ল--- পূৰ্ব্বসীমার মহালে পার্শ্ববর্তী জমিদারের সঙ্গে কি নিয়ে দাঙ্গা বেধেছে খবর পেয়ে তিনি তদারক করতে ছুটলেন । চন্দ্রনাথের ওপর এতবড় আয়োজনের ভার পড়ায় তিনি বিত্রত হয়ে উঠলেন । অপরিচিত লোকজন নিয়ে এ-সমস্ত সামলান তার পক্ষে এক দুরত্ব ব্যাপার। বহুদিন থেকে নির্লিপ্ত শাস্তির মাঝে বাস করে এ-সব সাংসারিক বাঞ্চাটে তিনি এখন অনভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বিয়ের দিন সকাল হ’তে চন্দ্রনাথ অস্বস্থ বোধ করছিলেন, তবু কোন মতে যথাকর্তব্য করে গেলেন। সারাদিনের উপবাসে পরিশ্রম সহ হ’ল না । সন্ধ্যাবেল তিনি মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। খবর শুনে স্বহিত উৎকণ্ঠায় দিশেহারা হয়ে গেল ! এসব উৎসব-সজ্জা টেনে ফেলে দিয়ে চেতনাহীন চন্দ্রনাথের শয্যাপার্থে মন তার ছুটে যেতে চাইল,—বাধা পেয়ে সে বিবাহটার উপরই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল, বিবাহের আয়োজনগুলো তার কাছে একান্ত বিরক্তিকর এবং সমস্ত অনুষ্ঠান অর্থহীন লাগতে লাগল। চন্দ্রনাথের অসুস্থতায় কাজকৰ্ম্ম সব বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ল । আত্মীয় অনাত্মীয়ের সংখ্যা অগণ্য, কিন্তু সকলেই বিবাহ উপলক্ষে দু-দিনের জন্যে এসেছেন নানা জায়গা থেকে । মায়াপুরের নিঃসঙ্গ জীবনে অধিকাংশকে মুহিতা দেখেই নি কখন, যাদের বা দেখেছে তাদের সাথেও স্বল্পপরিচয় । গোলযোগের সীমা রইল না, কিন্তু বিবাহ স্থগিত থাকতে পারে না। কৰ্ত্তাহীন কৰ্ম্ম কোন মতে এগিয়ে চলল । একলা ঘরে বসে বসে বাইরের কোলাহল শুনে মুহিতার মায়াপুরের সে শাস্ত নীরবতা মনে পড়ছিল। নিত্য ভোরে যখন জলের মত স্বচ্ছ টলটলে আকাশে গোলাপী আভা ছড়িয়ে যায়, স্বহিত উঠে দেখত মন্দিরের ত্ৰিশূলে আলো পড়েছে, বেণুবনের মাথায় মাথায় আলো এসে লেগেছে, দীঘির আঁধার জলে রঙের কাপন জেগেছে—মুহিতার কাজে অকাজের সারাদিনের ছন্দটি যেন নীরবে বেজে উঠল এদের মাঝে। তার আঠারটি বছরের স্মৃতির লিপিকায় সে দীঘি, দেবালয়, মুকুলিত আশ্রশাখা, মৰ্ম্মরিত বেণুবন প্রতিদিনে কত মধুবিন্দু জমিয়ে গেছে !... বিদ্যুৎকে চম্কে দিয়ে মেঘ ডেকে উঠল, মেবান্ধকার আকাশকে দেখে মুহিতার মনে জাগল—সেই পল্পীজ্যোৎস্নাr— উত্তপ্ত গ্রীষ্ম-দিন-শেষে অলিনো শীতলপাটি বিছিয়ে চন্দ্রনাথ