পাতা:প্রবাসী (ত্রয়স্ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৪১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আষাঢ় দিনের পর দিন এই প্রাণান্তকর সাধনা চোখে দেখিয়া অজয়েরও মনে নিজেরই অজ্ঞাতে কাজের উৎসাহ জাগিয়৷ উঠিতেছিল বহুদিন হইতে একটি ঐতিহাসিক নাটক রচনার জন্য সে প্রস্তুত হইতেছিল, সম্প্রতি একদিন রাত্রির অন্ধকারে গ+ঢাকা দিয়া বাহির হইয়৷ স্বল্পাবশিষ্ট অর্থ হইতে কিছু কাগজ, দোয়াত, কলম, প্রভৃতি আবশ্বকীয় জিনিস সে কিনিয়া আনিয়াছে। অনেক কাটাকুট করিয়া দুই অঙ্ক অবধি লেখা হইয়াছে, আরও দিন দশবারে থাটিতে পারিলে হয়ত বইট শেষ হয়, কিন্তু সেই অবধি কেমন করিয়৷ তাহার চলিবে তাহা সে জানে না। তিনটাক এগারে আন লইয়৷ মুরু করিয়াছিল, যাহা বাকী আছে তাহাতে দুষ্টদিন, কি বড় জোর আর তিনদিন অৰ্দ্ধাশনে তাহার চলিতে পারে। তাহার পর কি উপায় হইবে ? তখনকার অবস্থাটাকে কিছুতেই সে কল্পনা করিতে পারিল না। ভাবিল, অদৃষ্ট এত নিৰ্ম্মম হইতে পারে না। আমি কাহারও সাহাধাপ্রার্থী হুইব না তাহ নিশ্চয়, কিন্তু অনাহারেও শুকাইয় মরিব না। কোনও অলক্ষ উপায়ে আমার সম্মুখের এই অন্ধকার পাষাণ প্রাচীর সরিয়া গিয়া আমার পথ খুলিয়৷ যাইবে। পৃথিবীর আলোয় যেদিন চোখ মেলিয়াছিলাম, জানি না কোথা হইতে এই আশ্বাস আমার মনে জাগিয়াছিল, আমি জয়লাভ করিব। তারপর জীবনের প্রতি পদক্ষেপে সেই আশ্বাস আমার কানে বাজিয়াছে, সমস্ত বাধাবিপত্তি কোন অদৃশ্য শক্তির নির্দেশে বারম্বার আমার পথ হইতে দূরে সরিয়া গিয়াছে। কাম্যবস্তু আমার পথে ভিড় করিয়৷ আসিয়াছে, আমি তাচ্ছিল্যভরে তাহার অধিকাংশকে হাত বাড়াইয়া লই নাই । আমার সেই-সমস্ত ত্যাগ-করা সম্পদ নিশ্চয় কোথাও কোনও হিসাবের খাতায় জমা করা আছে । আজ নিঃস্বতার দিনে, রিক্ততার দিনে আমি বঞ্চিত হইব না। দুপুরে নন্দকে লজিক্‌ পড়াইতে বসিয় বারবার সেদিন সে ভুল করিতে লাগিল। কিছুতেই বইয়ের পাতায় তাহার মন বসিল না। নন্দ হঠাৎ পড়ার মাঝখানে উঠিয়া পড়িল, কহিল, “আজ আর থাৰু-একটা দিন একটু বিশ্রাম করব।” তাহার অমনোযোগ বশতই যে নন্দ উঠিয়া-পড়িল তাহ বুঝিতে পারিয়া অজয় জোর করিয়াই তাহাকে আবার পড়িতে शृचण \Ov Mo বসাইল। নিজের মনকে ইহার পর একবারও আর সে হাত-ছাড়া করিল না । ভারি ত ব্যাপার, দ্বমুঠ খাইতে পাইবে কিঙ্গ পাইবে না, তাহাই লইয়া আবার এত ভাবনা ৷ কিন্তু এবার নন্দের দিক্ হইতে মনঃসংযোগের অভাব ঘটিতে . লাগিল। সে কিছুই শুনিতেছে না, অজয়ের প্রায় সমস্ত প্রশ্নেরই অদ্ভুত অদ্ভুত উত্তর দিতেছে। অগত্য বই বন্ধ করিয়া অজয় কহিল, “কি হয়েছে আজ তোমার ; এমন অমনোযোগ ত আগে আর কখনো দেপিনি।" নন্দ মাথা নীচু করিয়া একটু হাসিল মাত্র। ইহার পর সমস্তটা দিন অজয় তাহার নাটক লইয়া ব্যস্ত রহিল। এই নাটকে আলমগীর চরিত্রকে সে নৃতন চাচে ঢালিয়৷ গড়িতেছে। বাদশাহ শাহজহান জরাভারগ্রস্ত স্থবির, শিশুর মত কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত, তাহাকে লঙ্গয় রাজপরিবার অতিষ্ঠ। এদিকে সাম্রাজ্যের চতুঃসীমান্তে বহিঃশত্রু প্রবল। পূৰ্ব্বসীমান্তে দুৰ্দ্দান্ত মগ, পশ্চিমে পারঙ্গ, সমুদ্র-উপকূল জুড়িয় পর্তুগীজ, ইংরেজ, ফরাসী ওলন্দাজ। বুদ্ধ বাদশাহের বুদ্ধিভ্রংশজনিত নানাপ্রকার অকষ্মের ফলে রাজশক্তির অবস্থা দিনে দিনে শোচনীয়তর হইতেছে, অথচ রাজমন্ত্রীদের মধ্যে, শাহজাদাদের মধ্যে, রাজার খাস্ত্রীয় অনাস্ত্রীয় পাখদবর্গের মধ্যে এমন কেহ নাই যে সাহস করিয়া তাহার কোনও রাষ্ট্রব্যবস্থা বা অব্যবস্থার প্রতিবাদ করিতে পারে। হিন্দুস্থান চিরকাল বস্তু অপেক্ষ বস্তুর প্রতীকের প্রতি অধিকতর শ্রদ্ধাবান। ইহা বুঝিবার মত বুদ্ধি ছিল বলিয়াই আউরংজীব সাম্রাজ্যের সঙ্কট সময়ে পিতাকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া পিতৃসিংহাসন রক্ষা করিবার ব্যবস্থা করিলেন। সে-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিরুতবুদ্ধি অক্ষম বুদ্ধের নিরুপায় বিদ্রোহ তাহাকে ব্যথিত করিল, কিন্তু কৰ্ত্তব্যভ্রষ্ট করিতে পারিল না । হিন্দুস্থানকে রাষ্ট্রীয় সংহতি দান করিয়া অমিতশক্তিশালী করিয়া তুলিবার স্বপ্ন আশৈশব তাহার চক্ষে ; অজয় বলিতে চাহে, বাদশাহ আলমগীর রূপে ভারতকে একটিমাত্র ভেলবুদ্ধিহীন ধৰ্ম্মে দীক্ষিত করিবার স্কুশ্চেষ্টার মূলে র্তাহার আশৈশবের সেই স্বপ্ন। তৃতীয় অঙ্কে এই অবধি গল্পকে : টানিয়া জানিয়া সে যখন বাহিরে আসিয়া দাড়াইল, তখন অস্তোন্মুখ স্বর্ঘ্যের রক্তিম আভাষ কলিকাতার ধূমাচ্ছন্ন । আকাশও খামলী নববধূর মত সাজিয়াছে।