পাতা:প্রবাসী (ত্রয়স্ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৫৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শ্রাবণ সন্ধি এই দর্শকদিগের মধ্যে ভদ্রবেশধারী যুবকের সংখ্যাই বেশী। এ-দেশে স্ত্রীলোকের প্রায়ই অন্তঃপুরের বাহিরে যায় না, পর্দার আড়ালে থাকে তাই রক্ষা, নতুবা তাহাদিগকে সৰ্ব্বদা বাহিরে দেখিতে পাইলে এই সকল নারীমাংসলোলুপ ব্যাঘ্রগণ যে কি করিত তাহ! আমি ভাবিয়া পাই না। সে দিন এই বিষয় লইয়। দাদার সঙ্গে আমার তর্ক হইতেছিল। দাদা বলে, আমাদের দেশের পর্দাপ্রথাই এই জন্য দায়ী। পুরুষগণ নারীদিগকে গৃহের বাহিরে দেখিতে অভ্যস্ত নয় বলিয়৷ ফাকতালে কৌতুহল চরিভার্থ করিবার প্রবৃত্তি তাহাদের মধ্যে সৰ্ব্বদ জাগরূক থাকে । আর যেখানে স্ত্রীপুরুষের মধ্যে মেলামেশার সুযোগ আছে সেখানে পুরুষের এরূপ অযথা কৌতুহল থাকে না। কথাটা সত্য হইলেও সম্পূর্ণ সত্য নহে। কত ইংরেজী উপন্যাসে পড়িয়াছি, একটি তরুণী রমণী (বিশেষ সে যদি সুন্দরী হয় ) পথঘাটে রেলষ্টীমারে কত লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যদিও এই বৰ্ব্বরোচিত লোলুপতার জন্য তাহারা আবার ধমকও খায়। সেদিন একটা বেশ মজা হইয়াছিল। লতিকা নামে আমার কলেজের একটি সঙ্গী আছে। সে বিলাত-ফেরৎ মিঃ সি. বোসের মেয়ে, খুব সুন্দরী, উত্তম বেশভূষা করিতে ভালবাসে, ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজে চলাফেরায় অভ্যস্ত। আমরা একসঙ্গে বায়স্কোপ দেখিতে গিয়াছিলাম। আমরা যখন বাহিরে আসিতেছিলাম, তখন দুই-তিনটি যুবক একটু দূরে দাড়াইয় আড়চোখে আমাদের দিকে তাকাইয়৷ কি বলবলি করিতেছিল। লতি অমনি সপ্রতিভ ভাবে তাহাদের নিকট গিয়া বলিল, “এই আমি আপনাদের সামনে এসে দাড়ালুম, কি বলতে চান সাম্ন-সামনি বলুন।" তাহার সেই রণোন্মুখী মূৰ্ত্তি দেখিয় তাহারা হতভম্ব হইয়া পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওমি করিতে লাগিল। লতি বলিল, ছিঃ, আপনার না ভদ্রলোক, আপনার না লেখাপড় শিখেছেন ? তখন একটি ছোকরা হাতজোড় করিয়া বলিল, “আমরা কোন দোষ মনে করি নাই, আমাদের মাপ করুন।’ আমি তখন লতির হাত ধরিয়া টানিয়া আনিয়া গাড়ীতে আসিয়া উঠিলাম। দাদা বলে, পুরুষেরা যে মেয়েদের দিকে আকৃষ্ট হয়, ইহাতে সে বেচারাদের দোষ কি ? ঈশ্বরই তাহার গৃঢ় উদ্দেশু সাধনের জন্য স্ত্রীজাতিকে পুরুষের চোখে রমণীয় করিয়া স্বষ্টি করিয়াছেন। তার পর নারীর আবার তাহাদের স্বাভাবিক সৌন্দৰ্য্য নান কৃত্রিম উপায়ে অর্থাং মনোহর বেশভূষা দ্বারা বাড়াইয়া থাকেন। ইহাতে পুরুষ-বেচারাবা সেই রূপের মোহে মুগ্ধ ন হইয় যাবে কোথায় ? কিন্তু আমি দাদার এই যুক্তি মানি না। ঈশ্বর নারীজাতিকে এরূপ কোন হীন উদ্দেশ্বে স্বষ্টি করিয়াছেন আমি তাহ বিশ্বাস করি না । পুরুষের ন্যায় নারীরও একটা স্বাধীন সত্তা আছে, পুরুষের ন্যায় নারীও স্বতন্ত্রভাবে তাহার জীবনের সার্থকতা সম্পাদন করিতে পারে। পুরুষ আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য নারীকে আপন পদতলে দলিত করিয়া রাখিয়াছে। এখন নারীর উপযুক্ত শিক্ষা দীক্ষা লাভ করিয়া নিজের স্বাতন্ত্র্য সংস্থাপন করিবার সময় আসিয়াছে। যাহা হউক, আমি এই সকল বিষয় চিন্তা করিয়া আমাদের হিন্দুসমাজের প্রচলিত প্রথা অনুসারে বিবাহের ফঁাদে ধরা দিয়া নিজের স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিতে সম্মত হই নাই, এ-কথা পূর্বেই বলিয়াছি। আমি এই সকল বিষয় লইয়া কেবল দাদার সঙ্গে তর্ক করিয়া ক্ষান্ত হুই নাই। আমি এ-সম্বন্ধে একটা প্রবন্ধ লিখিয়া ‘ভারতপ্রভা’ নামক মাসিক পত্রিকায় পাঠাইয়াছিলাম। তাহাতে নিজের নাম না দিয়া একটা ছদ্মনাম দিয়াছিলাম। ঐ প্রবন্ধ ছাপা হইয়াছিল। ক্রমশঃ