পাতা:প্রবাসী (ত্রয়স্ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৫৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পল্লী-সংস্কার ও শিল্প-প্রতিষ্ঠা ঐহেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ দীর্ঘ সাতাশ বৎসর পূৰ্ব্বে ১৯০৭ খৃষ্টাব্দে আমি কলিকাতা রিভিউ পত্রে বাংলার পল্লীর অবনতি সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিথিয়াছিলাম। তাহ প্রবাসীর শ্রদ্ধেয় সম্পাদক মহাশয়ের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিয়াছিল এবং তিনি নবেম্বর মাসের ‘মডার্ণ রিভিউ পত্রে তাহার উল্লেখ করিয়া বলিয়াছিলেন— বাংলার পল্লীগ্রামের উন্নতিসাধন দুঃসাধ্য হইলেও অসাধ্য নহে। জাতিহিসাবে বাঙালীর অস্তিত্ব এই সমস্যার সমাধানের উপর নির্ভর করিতেছে ; কারণ, বাংলার শত করা ৯৫ জন লোক পল্লীগ্রামবাসী। তিনি দেশের শিক্ষিত লোকদিগের নিকট ঐ মূল প্রবন্ধের ও তাহার অনুবাদ প্রচার করিতে বলেন এবং আমাকে উপদেশ দেন –আমি যেন কিছুকাল এ-বিষয়ে লোকমত গঠনকাধ্যে আত্মনিয়োগ করি। র্তাহার সেই উপদেশ আমি বিস্তৃত হই নাই এবং তদবধি সাংবাদিকরূপে এ-বিষয়ে বাংলার শিক্ষিত-সম্প্রদাসের মনোযোগ আকৃষ্ট করিতে চেষ্টা করিয়াছি। কিন্তু দুঃসাধ্য কাৰ্য্য দিন দিন যেন অসাধ্য হইয়া আসিয়াছে। কায্যের বিরাটত্ব স্বায়ত্বশাসনবঞ্চিত দেশের লোককে নিরাশ করিয়াছে এবং ইংরেজের আমলাতন্ত্র এদিকে মনোযোগ দেন নাই। ফলে দাড়াইয়াছে, নগরে নগরে পরদীপমালা’ আরও উজ্জল হইয়াছে এবং পল্লীগ্রাম যে তিমিরে সে তিমিরেই থাকে নাই পরস্তু তাহার দুর্দশার অন্ধকার নিবিড়তর হইয়াছে। যত দিন গিয়াছে, পল্লী তত জনহীন ও শ্রীহীন হইয়াছে ; তথায় পানীয় জলের অভাব অনুভূত হইয়াছে, জলনিকাশের ব্যবস্থা উপেক্ষিত হইয়াছে, স্বাস্থ্য ক্ষুন্ন হুইয়াছে, দেবায়তন ধূলিসাং হইয়াছে, অযত্নে যেসব লতাগুল্ম বৰ্দ্ধিত হয় সে-সকল স্বচ্ছন্দে পরিত্যক্ত বাসস্থান অধিকার করিয়াছে। পল্লীগ্রামের লোকের দারিদ্র্য বৃদ্ধির নানা কারণের মধ্যে শিল্পধ্বংস যে অন্যতম তাহ অস্বীকার করিবার উপায় নাই। কিন্তু এ-দেশের যে-সব শিল্প সকল সভ্য দেশে প্রসিদ্ধ ছিল এবং যে-সকল শিল্পের উৎপন্ন পণ্যের বিনিময়ে দেশের লোক বিদেশ হইতে অর্থ আহরণ করিত সে সকল শিল্পই পল্লীগ্রামে পরিচালিত হইত। তিন হাজার বৎসর পূৰ্ব্বে যে-সব পণ্য বিক্রয় করিয়া ভারতবর্য ধনশালী হইয়াছিল, সে-সবই পল্লীগ্রামে উৎপন্ন হইত। সার জর্জ বার্ডউড তাহার ভারতীয় শিল্পবিষয়ক পুস্তকে লিথিয়াছেন – “গ্রামের প্রবেশ-পথের বাহিরে উচ্চ ভূমিতে বসিয়া কুপ্তকার তাহার চক্রে করসঞ্চালন দ্বারা নানা দ্রব্য প্রস্তুত করিতেছে । গৃহগুলির পশ্চাতে গমনাগমন পথে কয়পানি ষ্টাত চলিতেছে, সেগুলির সান বৃক্ষে বুলান আছে এবং নীল, লোহিত ও স্বর্ণসূত্রে যখন বস্ত্র বয়ন করা হইতেছে তখন স্বত্রের উপর বৃক্ষ হইতে ফুল ঝরিয়া পড়িতেছে। পথে পিত্তলের ও তাম্রের পাত্ৰাদি প্রস্তুতকারীর সশন্সে কাজ করিতেছে। ধনীর গৃহে অলিনো বসিয়া স্বর্ণকার ও মণিকার চারিদিকের ফল ও ফুল এবং বিকশিত শতদল পুষ্করিণীর কুলে আম্রকুঞ্জ মধ্যে অবস্থিত দেবায়তনের প্রাচীরে অঙ্কিত চিত্র হক্টতে আদশ লইয়া নানারূপ অলঙ্কার প্রস্তুত করিতেছে।” অৰ্দ্ধ শতাব্দী পূৰ্ব্বেও সার জর্জ ভারতের পল্লীগ্রামে এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। অৰ্দ্ধ শতাব্দীর মধ্যে সে অবস্থা সম্পূর্ণ পরিবর্তন হইয়াছে। ধনীর গ্রাম ত্যাগ করিয়৷ আসিয়াছেন ; গ্রামে আর শিল্প নাই বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। এখন গ্রামের লোক অন্ত স্থান—বিশেস বিদেশ হইতে আমদানী দ্রব্য ব্যবহার করিতেছে। রুমির আয় হ্রাস হইলে তাহার আর কিছুতেই পরিবার পালন করিতে পারে না। পল্লীগ্রামে বেকারের সংখ্যা বাড়িতেছে এবং যে মধ্যবিত্ত ভদ্র’ সম্প্রদায় সমাজের মেরুদণ্ড ছিলেন, তাহারা গ্রাম ত্যাগ করিয়া আসিতেছেন । এই অবস্থায় পৃথিবীব্যাপী আর্থিক দুৰ্দ্দশার উদ্ভব হইয়াছে। জার্মান যুদ্ধের পরই এই অবস্থা ঘটিয়াছে। ইউরোপে নেপোলিয়নিক যুদ্ধ শেষ হইলে একবার কতকটা এইরূপ দুর্দশ ঘটিয়াছিল। সে যুদ্ধের অবসানে কৃষক তাহার পণ্য বিক্রয়ের বাজার হারাইয়াছিল, সৈনিকরা কর্মচ্যুত হইয়াছিল, সমরসরঞ্জামপ্রস্তুতকারীর আর কোন কাজ পায় নাই। কিন্তু জার্মান যুদ্ধের বিরাটত্ব অধিক এবং যান্ত্রিক যুগের উন্নতিকালে তাহা সংঘঠিত হয়। কাজেই এবার আর্থিক দুর্দশা অধিক