পাতা:প্রবাসী (ত্রয়স্ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৫৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শ্রমের মর্ধ্যাদা ও বাঙালীর বিমুখতা শ্ৰীপ্রফুল্লচন্দ্র রায় লেখাপড়া ও চাকরি কেহ কেহ আমার প্রতি এই অভিযোগ করিয়া থাকেন যে, আমি বাঙালী ছেলেদের কেবল মাড়োয়ারী হইতে বলি,— যেন আমি আমার জীবনে সরস্বতীর উপাসনা বর্জন করিয়া কেবল ধনোপার্জনেই মত্ত আছি। এই অভিযোগটি নিশ্চেষ্টত ও শ্রমবিমুখতার অজুহাত মাত্র । স্কুল ও কলেজে বৎসরে প্রায় চার-পাচ মাস ছুটি এবং পোষ্ট-গ্রাজুয়েটে সাত মাস, মৃতরাং বিদ্যাশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যৎ জীবনে কি পন্থ অবলম্বন কায়, বে তাহার উপায় নিৰ্দ্ধারণ ও সেই পথ অনুসরণ করিতে পারিলে বঙালী যুবকের হয়ত এইরূপ দুর্দশাগ্রস্ত হইতে হইত না। কিন্তু গোড়ায়ই গলদ, আজ যে দুৰ্দ্দিন আসিয়াছে ইহার জন্য ছাত্রগণ অপেক্ষ অভিভাবকগণই বেশী দায়ী। বাস্তবিক তাহারা ভাবিয়া দেখেন না যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারীদের কি ভীষণ পরিণাম । আমি বলিয়া বলিয়া হয়রান হইয়াছি যে, দশ হাজার আইনের উপাধিধারীর মধ্যে (বি-এল ; এম-এ বি-এল ; এম্-এল্ ; ডি-এল) হয়ত মাত্র একজন হাইকোর্টের জজ বা এডভোকেট-জেনারেল হইবে এবং এই শ্রেণীর এক হাজার উপাধিধারীর মধ্যে হয়ত একজন মুনসেফ, সবজজ বা পশারী উকিল হইবে। আমি জিজ্ঞাসা করি, আর আর সকলের কি উপায় হইবে ? আলিপুর কোর্টে সহস্ৰাধিক উকিল এবং মফস্বল জেলা ও মহকুমায়ও নিতান্ত কম হইবে না। আমার ক্ষুত্র খুলনা জেলার সদরেই দেড়-শ জন উকিল, এবং সাতক্ষীরা বাগেরহাট প্রত্যেক মহকুমাতেও একশ জনের কম হইবে না। খোজখবর কবিয জানিয়াছি যে, ইহাদের মধ্যে শতকরা পাঁচ জনের এক প্রকার আয় আছে এবং শতকরা দশ জনের কোন রকমে চলে, আর বাকী ধাহারা আছেন তাহাদের যে কি প্রকারে দিন গুজরান হয় তাহ জিজ্ঞাসা করিলে কোন উত্তর পাই না। র্তাহারা কি বাতাস খাইয়া থাকেন ? ছোট আদালতে ও পুলিস কোর্টে গেলে দেখা যায়, উকিলবর্গ একেবারে মৌমাছির মত ঘিরিয়া ফেলে, অনেকের হয়ত ট্রামের ও বাসের ভাড়া জোটে কি-না সন্দেহ । আমি বক্তৃতাপ্রসঙ্গে অনেকবার বলিয়াছি যে, স্তর রাসবিহারী ঘোষ একজন এম-এ, বি-এল, স্তর আশুতোষ একজন এম-এ, বি-এল, শ্ৰীমানরাও এম-এ, বি-এল হইবার জন্য ব্যস্ত, কারণ ইউক্লিডের স্বতঃসিদ্ধের মত "যে বস্তুগুলি একই বস্তুর সমান তাহার। পরস্পর সমান হয়।” ‘হায়! কত উজ্জল প্রতিভা বহ্নিমুখং পতঙ্গমিব হুতাশনে ভস্মীভূত হইয় বিনষ্ট হইয়া যায়, কত আশা-ভরস, কন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষা মাত্র ত্রিশ-পয়ত্রিশ টাকার কেরাণীগিরিতে পৰ্য্যবসিত হয় ; তাহাও আজকাল দুষ্প্রাপ্য। আদালতের একটি নকলনবিশের জন্য বিজ্ঞাপন প্রদত্ত হইলে বোধ হয় কয়েক শত প্রার্থীর আবেদনপত্র আসিম দাখিল হয় এবং তাহার মধ্যে এম-এ, বি-এলও পাওয়া যায়। পচিশ বৎসর পূৰ্ব্বে পরলোকগত ভূপেন্দ্রনাথ বস্তু মহাশয় একবার বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় বলিয়াছিলেন, “The law has been the grave of many brilliant careers” এখন জিজ্ঞাসা করি, এক্ট হৃদয়বিদারক অবস্থার জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ী কে ? পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি গোড়ায়ষ্ট গলদ । আসল কথা এই যে আমাদের মা-বাপ ও অভিভাবকগণ বংশপরম্পরায় প্রচলিত এক ভ্ৰমাত্মক সংস্কার হৃদয়ে পোষণ করিয়া আসিতেছেন যে, যেন-তেন-প্রকারেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভকৃমা না মিলিলে বুঝি জীবন ব্যর্থ ইষ্টয়া যাইবে। প্রায় পচিশ বৎসর পূৰ্ব্বে “বাঙালীর মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহার” শীৰ্ষক প্রবন্ধে ইহার কতকটা অবতারণা ও আলোচনা করিয়াছি । রাজনারায়ণ বস্থর ‘সেকাল ও একাল পুস্তক পাঠে অবগত হওয়া যায় যে সেই সময় যে-ব্যক্তি কতকগুলি ইংরেজী কথা বা ছড়া বলিত তাহারই জয়জয়কার। ইংরেজ সওদাগরের আপিসে চাকরিরও খুব স্ববিধ ছিল।