পাতা:প্রবাসী (ত্রয়স্ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৫৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আছে কি না জানিতে চায় ? অজয় তবু ত নন্দের কথা সমস্তক্ষণই ভাবিতেছে। লালবাজারে গিয়া তাহার খোজই নাহয় করে নাই, কিন্তু এবার সে ফিরিলে দুইজনে অন্ততঃ পেট ভরিয়া যাহাতে খাইতে পায় সেজন্য প্রাণপণ করিয়া সে প্রস্তুত হইতেছে.। আর তাহার অন্তৰ্য্যামী জানেন, নন্দ ফিরিয়া আসিলে সে খুলি হয়, অত্যন্ত বেশী খুসি হয়। আর কোনো কারণে না হউক, এই পুরান ভাঙা ভূতুড়ে বাড়ী, লোহার গরাদে দেওয়া সরু সরু দরজা-জানালা, মাকড়সার জালে জড়ান অন্ধকার আনাচ-কানাচ, আগাছার ঝাড়...সমস্ত রাত ধরিয়া জুতলার বারান্দায়, সিড়িতে, ছাতে কি যে সব দুপদীপ ফিসফাস শব্দ...যে-কোনো একটা মানুষ কাছে থাকিলে প্রাণে তবু ভরসা থাকে। আধ-ময়লা বিছানাটাতে বালিসে বুকের ভর দিয়া উপুড় হইয়া পড়িয়া উপবাস-ক্লিষ্ট দেহে দিন-রাত অবিশ্রান্ত নাটকের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখিতেছে, কাটিতেছে, আবার লিখিতেছে। কিন্তু দুৰ্ব্বল বুক দুরুদুরু করিম কাপে যে ! কোনে-এক সময় বইটা শেষ হইবে এবং হয়ত আশাতীত সাফল্যের মধ্যে শেষ হইবে, এই চিন্তাই বইটিকে শেষ করিবার পথকে বাধার মত হইয়া জুড়িয়া থাকে, যত বেশী তাড়াতাড়ি করিতে যায় তত বেশী করিয়া দেরি হয় । তৰু সত্যসত্যই বইটি একদিন শেষ হইল। সেদিন অজয়ের সে কি আনন্দ । জীবনে আর কখনও আর কোনও কিছুতে এতখানি আনন্দ সে পায় নাই, নিজের কাছে মুক্তকণ্ঠে তাহা স্বীকার করিল। সেদিন একাদিক্রমে তৃতীয় দিনের উপবাস চলিতেছে । শেষ ডাল-ভাত-পুঁইয়ের-চচ্চড়ি খাওয়ার পর যে ছয়টি পয়সা বাকী ছিল তাহ দিয়া একদিস্ত কাগজ কিনিয়াছিল। তাহার পর হইতে মাঝে মাঝে কলতলায় গিয়া আঁজলা করিয়া জল খাইয়াছে, এক পয়সার ছোলাভাজাও এই ক'দিন জোটে নাই। কিন্তু সে কুচ্ছ সাধন তাহার সার্থক হইয়াছে। নিজের সম্বন্ধে নিরপেক্ষ বিচারের ক্ষমতা অজয়ের চেয়ে বেশী আর কাহার আছে ? সে জানে, তাহার এই প্রথম উদ্যমেই বইটি আশাতীত-রূপ ভাল হইয় উৎরাইয়াছে। বইটিকে অভিনয় করাইবার চেষ্টা কাহার যোগে SKDBO তাহা ঠিক ছিল। ইউনিভার্সিটি ইনষ্টিটিউটের এক গানের জলসায় দুই বৎসর আগে লোকটির সঙ্গে তাহার প্রথম আলাপ। তখন পাখোয়াজে খুব ভাল হাত বলিয়াই কানাইয়ের একমাত্র প্রতিষ্ঠা। আজ বাংলা দেশে কানাইলাল ঘোষের নাম শোনে নাই এমন লোক বিরল। প্রতিভাবান অভিনেত, কৃতী নাট্যকার এবং শক্তিশালী প্রযোজক বলিয়া তাহার নাম অন্ততঃ কলিকাতায় সকলের মুখে মুখে । সহরের শ্রেষ্ঠ যে নাটমন্দির তাহার উপর কানাইলালের একাধিপত্য। তখন সান্ধ্য অভিনয়ের এক পৰ্ব্ব শেষ হইয়া দ্বিতীয় পর্বের আয়োজন চলিতেছে। রঙ্গমঞ্চের পিছনে এই দিকৃটা দিয়া স্ত্রীদের এবং পুরুষদের পৃথক পৃথক গ্রীনুক্ৰমে যাইবার রাস্তা। দুয়ের মাঝামাঝি জায়গায় কানাইলালের ঘর, একাধারে তাহার রূপসজ্জাগার ও বৈঠকখানা। ছোয়াচের ভয় অজয়ের মনে ছিল, কিন্তু এক কানাইলাল ভিন্ন আর কাহাকেও কোথাও সে দেখিতে পাইল না। অজয়কে দেখিবা-মাত্র কানাই চিনিতে পারিলেন, সৌজন্য সহকারে তাহাকে বসাইলেন, যত শীঘ্র সম্ভব নাটকের পাণ্ডুলিপি পড়িয়া দেখিবেন এ প্রতিশ্রুতিও না চাহিতেই আদায় হইল। সেদিন আর বেশী কথা বলিবার সময় ছিল না, আসিবার মুখে একটা চাকর দুপেয়াল চা এবং কিছু খাবার রাখিয়া গিয়াছিল, সেগুলি শেষ না করিয়াই চলিয়া আসিতে হইল । সে রাতটা ছটফট করিয়া কাটিল, পরের দিনটাও । কি ভুলই সে করিয়াছে, আজিকার দিনের মধ্যে বইট: পড়িয়া রাখিতে কানাইবাবুকে সে বলিয়া আসে নাই।...শরীর মন দুইই এলাইয়া পড়িতেছে, হয়ত কাল আর বিছানা ছাড়িয়া উঠিবার ক্ষমতা থাকিবে না। জানে, এক দিনেই কিছু আর বইটা কানাইবাবুর পড়া হইয়া যায় নাই ; ইহাও জানে, এত বেশী গরজ প্রকাশ করিলে নিজেকে অত্যন্তই ছোট করা হইবে। তৰু সন্ধ্যায় কে তাহার ক্ষুৎপীড়িত ক্লান্ত দেহটাকে জোর করিয়া টানিয়া কানাইয়ের দরজায় হাজির করিল। - কানাইয়ের ঘরে আজ দস্তুর মত লোকের ভিড় । সকলের সঙ্গে তাহার পরিচয় করিয়া দিবার ঘটা দেখিয়াই অজয় বুঝিল, বইটি পড়া হইয়াছে, এমন কি দলের মানুষগুলির মধ্যে তাহা লইয়া একপাল আলোচনাও হইয়া গিয়াছে ।