পাতা:প্রবাসী (ত্রয়োবিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৬২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৫ম সংখ্যা ) । দুইটা ছোট কুকুর কোন অঞ্চকে পথ দেখাইয়া লইয়া যায়, সেইরূপ আমার বাচ্চ পাণ্ডাদ্বয়ের প্রত্যেকেই আমার এক-একটা হাত ধরিয়৷ লইয়া যাইতে লাগিল । চোক বাধা থাকিলে কোনো ব্যক্তি যেরূপভাবে চলে, আমি সেইরূপ—ইতস্ততোভাবে পদক্ষেপ করিতে লাগিলাম। উহার খুব সাবধানে, দক্ষতসহকারে পথের ঠিক মাঝখানে আমাকে রাখিয়া দিতেছিল । উহাদের নিজের পী কিনারায় বড় বড় গাছপালায় জড়াইয়া যাইতেছিল, অথবা গৰ্ত্তের মধ্যে ঢুকিয়া যাইতৃেছিল । এই নিবিড় পত্রপল্লবের মধ্যে, যেন একটা কি আমাদের সম্মুখ দিয়া পলাইয়া গেল। গিরগিটি কিংবা পার্থী কিংবা ঘুমাইতেছিল এমন কোন পশু। আমাদের ভয় হইল। কখন কখন আমার মনে হইতেছে, ক্ষুদে পাণ্ডীদ্বয় একটা খুব সরু তক্তার উপর দিয়৷ আমাকে লইয়া যাইতেছে, অথচ উহাদের প{ জলের মধ্যে ঝপ, ঝপ করিয়া পড়িতেছে। পথের উপর দিয়া একটি ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনী বহিয়া যাইতেছে—তাহার উপর একটা ছোট সাকে । এরূপ ঘনঘোর অন্ধকার যে, অtমার চোখ লজিয়া থাকিতে ইচ্ছ। হয়। ডালপাল তৃণের ফ্যাকৃড়, আমার মুখের উপর যেন চাবুক মারিতেছে । আর সেই চিরন্তন মৃগনীভিসিক্ত তপ্ত গন্ধ,-ধtহ মাটি হইতে উথিত হয় এবং বন জঙ্গলে প্রবেশ করিবমাত্র যাহার দরুন একটু কষ্ট পাইতে হয় । উহারা বলিল, আমরা আসিয়া পৌঁছিয়াছি । তখন আমি চাহিয়া দেখিলাম, এবং পত্রপল্লবের স্তিতর দিয়া দেখিতে পাইলাম, অনেকট আলো বিকৃমিক্‌ করিতেছে, এমনভাবে কম্পিত হইতেছে যেন এখনি নিৰ্ব্বাপিত হইবে।—এইসব আলোকরশ্মি এমন মিটুমিটে ধরণের, এরূপ ক্ষুদ্র যে, মনে হয় যেন কতকগুলি ক্ষুদ্র অনলশিখা কীটগাত্র হইতে নিঃস্থত হইতেছে। তা ছাড়া এই আলোগুলা বেশ সমানভাবে স্থাপিত ; দেখিলে মনে হয় যেন একটা বড় দাব|খেলার ছকু-যাহার প্রত্যেক কোণ জোনাকির আলোকে আলোকিত । উইlরা বলিল –এই সেই মন্দির, ই২ার সম্মুখ ভাগটা এইরূপ অদ্ভুতধরণে অালোকিত হইয়াছে। বনের ভিতরকীর একটা পরিষ্কার ফ'কা জায়গায় আমরা প্রবেশ করিলাম । উপর হইতে তারার আলো নিপতিত হইতেছে । বনের ঘনঘোর অন্ধকার ও শ্বাসরোধী নিবিড়তার পর, মনে হইল, এই স্থানট একটু যেন আরাম ভোগ করিতেছে। আমাদের সম্মুখেই মন্দিরটি রহস্যময় দীপালোকে আলোকিত, এই আলোক অননুভবনীয় নৈশ বায়ুর প্রত্যেক নিঃশ্বাসে কম্পিত হইতেছে এবং অবিরত নিৰ্ব্ববাপিত হইতেছে । এই মন্দিরটি অতি সামান্তরকমের, খুব নীচু, কীটদষ্ট পুরাতন কাঠের একটা কুটার মাত্র ৷ তক্তার দেওয়ালের ভিতর একপ্রকার লোহার চামচ, হাতলের দ্বারা, ঢুকাইয়া দেওয়া হয়— সমান-সমান অস্তরে,--ছাদ পর্য্যস্ত। প্রত্যেক চামচে তেল ভরিয়া দেওয়া হয়, এক-একটা মোমের পলুতে এই তেলে ডোবানে থাকে —তুণ-বৃন্তের মতে সরু । শেষে এই পলুতেটা পুড়িয়া যায়।...... চারিদিকে জনমানব নাই, ভিতরেও কোন লোক নাই, কেননা দ্বার অর্গল-বদ্ধ। তবে কে আসিয়া, এমম ক্ষণস্থায়ী ক্ষুদ্র আলোকগুলি জ্বালাইয় দেয় ?—এইসব আলোকের পরমায়ু ত মনে হয়, কয়েক মিনিট মাত্র । কোন গুপ্ত ক্রিয়াকাণ্ডের জম্বা, এইসব ক্ষণিক আয়োজন ? আমার বাচ্চ-পাণ্ডার। এসম্বন্ধে বেশী কিছু খবর দিতে পারিল না । উহার শুধু বলিল –“সন্ধ্যার সময় প্রায়ই এইরকম করা হয়ে থাকে .যখন কিছু চাহিবার আবখ্যক হয়... টুপটুপ, করিয়া দীপগুলা নিবিয়া যাইতেছে ; আবার এখনি কালে রাত্রি অtসিয়া পড়িবে। “মাহে”-নগর ჯა© (* তাহার আগেই আমার বাচ্চার। আমাকে মঙ্গিরের ভিতরট। দেখাইতে ইচ্ছ। করিল, মন্দিরের পুতুলগুলা দেখাইবে বলিল। তখনি উহার পুরাতন দরজাটা ঠেলিতে লাগিল—দরজtয় লোহা-লক্কড়ে উহাদের আঙ্গুল ক্ষতবিক্ষত হইয় গেল। দরজাটা প্রতিরোধ করিল —কাজেই ছাড়িয়া দিতে হইবে। দেওয়ালের মুমুধু আলোগুল৷ ক্রমাগতই নিবিয়া যাইতেছে। এখন কি করা যায় ? ভাল ভাল পুতুল দেখান আর হইবে না। ডহার বলিল—উহাদের বদলে, অন্ততঃ একটা পুরাতন পুতুল আমাকে দেখাইবে । এই পুতুলটা মন্মিরের পিছনে আবর্জনার মধ্যে ফেলিয়া রাখা হইয়াছে ; এটাও উহার। আর খুজিয়া পাইল না...অ । এই যে,...আমি পুতুলটা দেখিতে পাইয়াছি, অন্তত এইরূপ পুতুল বলিয়াই অনুমান করিতেছি ; একটা ভীষণ দৈত্যের আকৃতি —ঐখানে মাটিতে উবু হইয়া বসিয়াছে—দেয়ালের গায়ে ঠেসান দিয়া ।--একটা শেষাবশিষ্ট ছোট পলিতা এখনো জ্বলিতেছিল, ঐ পলিতা লইয়। ( হাত পুড়িবার আশঙ্কা সত্ত্বেও ) উহার পুতুলটার থুতির নীচে ধরিল ; ঐ আলোকে, আমি রূঢ়ধরণে গঠিত একটা ভীষণ মুখ দেখিতে পাইলাম –সরিসারি দুই পাটি দাত –একটা কপাল এবং ঘুনধরা দুইটা চোখ । উহার পাশে, খোদাই কাজের আর কতকগুলা মুৰ্ত্তির টুকুর ঘাসের উপর পড়িয়া আছে-ভাবে বোধ হয় কতকগুলী রাক্ষস-মূৰ্ত্তির ধ্বংসাবশেষ-কতকগুলা জজঘা, কতকগুল চিবুক । আর-একটা জিনিস দেথাবার আছে, শত্র, শীঘ্ৰ । বেশ দেখ। গেল, ৬হার এই জায়গায় অন্ধি-সন্ধি সব জানে । ইতিমধ্যে কনিষ্ঠ পাওtট পুব চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে—আঙ্গুলগুলা তেলে ভরিয়া গিয়াছে। উহার চামচগুলার মধ্য হইতে, কতকগুলা পলিতার আগ বাছিয়া লইল ধাহ! এখনে জ্বালাইতে পার! যাইবে । এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, অঙ্গুষ্ঠের উপর ভর দিয়া উচু হইয় দাড়াইল— তাহার পর উপরে উঠিয়া ছাদের বর্গার নীচেটা হাতড়াইতে লাগিল...অবশেষে যাহাকে খুজিতেছিল, তাহার উপর হস্ত স্থাপন করিল –একটা কাঠের মুদ্র রাক্ষস,— রাঢ়-ধরণের, ক্ষয়গ্ৰস্ত, মামুষের শরীরের উপর অস্পষ্টরকমের একটা হাতীর মাথা । উহারা দুই জনেই উহার মুখের সামূলে হাসিতে লাগিল ; তাহার পর, তাড়াতাড়ি আবার উহার গৰ্ত্তের মধ্যে উহাকে ঢুকাইয়। দিল । ঐখানে করে কি, এই দেবতাট ? পার্থীদের নীড়ের সঙ্গে, ছাঁদের নীচে কেন বাস করিতেছে ?... ডহার আরও কতকগুলী ছোট পলিতা খুজিয়ী পাইয়াছে । আমাদের যাত্রা-পথে, একটার পর একটা জ্বালাইতে লাগিল , উহাদের আলোকে আমরা বনভূমি পার হইয়৷ সেই বড় রাস্তায় গিয়া পড়িব-যেখান হইতে আমরা যাত্র আরম্ভ করিয়াছিলাম। এই অদ্ভুত পলিতাগুলা মিটমিট, করিয়া জ্বলিতেছে ; এই আলোয় আমর মধ্যে মধ্যে পাতার মতে একটা-কিছু দেখিতে পাইতেছি । একটা তল-গাছের তলা দেখিতে পাইতেছি কিংবা অন্ধকারে সবুজের ভিতর হইতে হঠাৎ-বিচ্ছিন্ন আর্কিডের কোন ফুল দেখিতে পাইতেছি। তাহার পর, শেষাবশিষ্ট সলিতাটা পুড়িয়া গেলে, উহা ঘাসের উপর উহার ছুড়িয়া ফেলিল । আবীর আমাদের সেই পুৰ্ব্বাবস্থ৷ — ছয়টা চোখ একত্র করিয়াও এখন আর কিছুই দেখিতে পাইতেছি না। আমার পাওর। “ভ্যাবাচক খাইয়া” আমাকে একটা দুষ্প্রবেশ জঙ্গলের মধ্যে লইয়া গেল। এমন একটা জায়গায় --বেথানে আমার পা রহিয়াছে জলের ভিতর, আর আমার শরীর জড়াইয়া গিয়াছে ডালপালার মধ্যে ।